দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ২২২টি আসনে জয় পেয়েছে। জাতীয় পার্টি থেকে ১১ জন, স্বতন্ত্র থেকে ৬২ জন এবং অন্যান্য দল থেকে তিনজন প্রার্থী জয় পেয়েছেন।

২২২ আসনে জয় নিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল দলটি। এর পর থেকে একটানা ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।

এবারের নির্বাচনে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। আর ভোটের দিন একটি কেন্দ্রে অনিয়ম হওয়ায় ময়মনসিংহ-৩ আসনের ভোটের ফল স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। বাকি ২৯৮টি আসনের ফল পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী— ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে কোনো দল যদি ১৫১ আসনে বিজয়ী হয় তাহলে তারা সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে আগামী সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যদিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো মন্ত্রীসভা গঠন করা হবে।

বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ

ফলাফল ঘোষণার পর বিজয় মিছিল না করার নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর বরাতে এ নির্দেশনার কথা জানান আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান।

তিনি বলেন, ফলাফল ঘোষণার পর কোনো প্রকার বিজয় মিছিল না করার নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে অন্যপ্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সহিংসতা বা আত্মকলহে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

জানা যায়, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা নির্বাচন বয়কট করেছে। তারা শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে আন্দোলন করছে।

ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে বিএনপি ৬ জানুয়ারি সকাল থেকে ৮ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষিত কর্মসূচি এখন পালিত হচ্ছে। দলটির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চ এলডিপি ও জাতীয়বাদী জোট এবং গণফোরাম-পিপলস পার্টিও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন

রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া সারা দেশে নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে ২৯৯ আসনে। ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রার্থী ছিলেন ১৯৭১ জন। ভোট নেওয়া হয়েছে ব্যালট পেপারে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেছেন নির্বাচনে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বড় অংশই বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে তারা ভোটার উপস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে।

দিনের বড় ঘটনা হলো চট্টগ্রাম-১৬ আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল। পুলিশের এক ওসিকে ধমক দেওয়ায় এবং আগেও আচরণবিধি ভঙ্গ করার রেকর্ড থাকায় তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া চট্টগ্রামেই অপর এক ঘটনায় প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে নৌকার সমর্থক এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের দাবি, এটি নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনা নয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ইতিহাস

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জিতে প্রথমবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৩টি আসনে জয়লাভ করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৩০টি আসন। ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে দলটি।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। তৃতীয় বার সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা।

২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ২৫৯ আসনে জয় পায় দলটি। ফলে ৪র্থ বার এবং একটানা ৩য় বার সরকার গঠন করতে সমর্থ হন শেখ হাসিনা।

একনজরে নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরিসংখ্যান

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৬ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম, ২০০৮ সালে নবম, ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধয়াক সরকারের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবারের মতো নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করার পর সব শর্ত পালন করে ৩৯টি নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ নেয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সে অনুযায়ী মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন। ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ৭ কোটি ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৫ জন। ভোট পড়ার হার ছিল ৮৬.৩৪ শতাংশ। নির্বাচনের জামানতও ছিল ১০ হাজার টাকা।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, বিএনপি পায় ৩০টি আসন, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, জামায়াত ২টি, বিজেপি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১টি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ৪টি আসন।

এরপর বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ১১টি দল অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এককভাবে ২৩৪টি আসনে পায় তারা। নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪১ শতাংশ।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনেকটা ‘একতরফা’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি আসন পায় বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে। জাতীয় পার্টি ২২টি এবং মহাজোটভুক্ত অন্য দলগুলো ৮টি আসনে জয়ী হয়। অপরদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি ৬টি, গণফোরাম ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হন।

এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ। অপরদিকে, বিএনপি পেয়েছে মাত্র ১২.০৭ শতাংশ ভোট। নির্বাচনের কয়েক দিন পর নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ১৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। 

এমজে