প্রায় দুই বছর ধরে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে এক লাখের মতো কর্মী বিদেশ যাচ্ছেন। চলতি বছরের ১১ মাসে ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থানে হয়েছে। এটি দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। যা গত বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালে বিদেশে গেছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী।

বিদেশে কর্মী যাওয়ার রেকর্ড সুখকর হলেও অস্বস্তিও ছিল শ্রমবাজার নিয়ে। কেননা, যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে বাংলাদেশিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে কর্মীর কাজ না পাওয়ার দুর্ভোগ এবং বাংলাদেশের জন্য ওমানে সব ধরনের ভিসা স্থগিত করা সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তবে বছরের শেষপ্রান্তে বাংলাদেশিদের জন্য চার বছর পর মালদ্বীপের শ্রমবাজার খোলার সুখবরও ছিল।

করোনা মহামারি শুরুর পর বড় ধাক্কা খেয়েছিল বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ কর্মী বিদেশ গেছে। এসব কর্মসংস্থানের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে সৌদি আরব। দেশটিতে ১১ মাসে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন কর্মী গেছে। এরপরে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে মালয়েশিয়ায়, দেশটিতে কর্মী গেছে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ কর্মী গেছে ওমানে, দেশটিতে গেছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ জন।

বিএমইটি তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন বিদেশ যান। ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন বিদেশ যান। ২০১৯ সালে বিদেশ গেছে ৭ লাখ ১৫৯ জন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং শ্রমখাত নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার কারণে রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের অনেক দেশে কর্মী যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে দক্ষ কর্মী পাঠাতে বেশি জোর দিতে চায় সরকার।

চলতি বছরের প্রথম চার মাসে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার দেশে সুদানে যায় ২২০ বাংলাদেশি। ওই সময়ের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। সুদানে প্রায় এক হাজার ৫০০ বাংলাদেশি নাগরিক বসবাস করছিল। যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে বাংলাদেশিদের ফেরাতে বেশ হিমশিম খেতে হয় খার্তুমের বাংলাদেশ মিশনসহ সংশ্লিষ্টদের। গত ৮ মে প্রথম দফায় জেদ্দা দিয়ে ১৩৬ বাংলাদেশিকে ঢাকায় ফেরানো হয়। পরবর্তী সময়ে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খার্তুমের এবং রিয়াদের বাংলাদেশ মিশন কয়েক দফায় যুদ্ধকবলিত দেশটি থেকে হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনে।

চলতি বছরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়ার শীর্ষ স্থানে রয়েছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। দুটি দেশে যাওয়া অনেক কর্মীর কাজ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া যাওয়া নোয়াখালীর বাসিন্দা আব্দুর রহমান হোয়াটঅ্যাপে সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু শুধু কর্মী পাঠিয়ে তো লাভ নাই, যদি কাজ না থাকে। এখানে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক আছে যারা ঠিকমতো কাজ পাচ্ছে না। আবার যারা কাজ করছেন নামে মাত্র বেতন, যা দিয়ে নিজে চলা কঠিন।

চলতি বছরের অক্টোবরের শেষে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা দেওয়া স্থগিত করেছে ওমান। দেশটিতে অতিরিক্ত বাংলাদেশি কর্মী হয়ে যাওয়া এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারায় এমন সিদ্ধান্ত নেয় ওমান সরকার। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধাকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান রয়েছে। দেশটি বাংলাদেশি জন্য ভিসা স্থগিতের বিষয়টি উঠিয়ে নেবে।

বিএমইটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ওমানে কাজ করতে গেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ জন। গত বছর ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬১২ জন কর্মী দেশটিতে গেছে। যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্মী যাওয়ার রেকর্ড। আর দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৮ লাখের বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব (সদ্য সাবেক) আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আগামী বছর হয়তো এই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। তবে আমরা যেনতেনভাবে বিদেশ কর্মী পাঠাব না।বেতন নিরাপত্তাসহ সবকিছু নিশ্চিত করে তবেই বিদেশে পাঠাব। আমরা দক্ষ কর্মীতে বেশি জোর দিতে চাই, যেন আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বাড়ানো যায়।

চলতি মাসে বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে মালদ্বীপ সরকার। চার বছর ধরে বন্ধ ছিল এ প্রক্রিয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে অদক্ষ শ্রমিক দেশটিতে কাজের সুযোগ পাবে।

দেশটিতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট করতে দেওয়া হবে না বলে সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্সংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন।

ওমানে বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ থাকা শ্রমবাজার প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণসচিব বলেন, ওমানে বাংলাদেশি শ্রমিক যাওয়ার বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা প্রত্যাহারে সরকার কাজ করছে। ইতোমধ্যে ওমানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। অচিরেই ওমানে কর্মী পাঠানোর বিষয়টি সুরাহা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

৩০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রবাসী দিবস উপলক্ষ্যেে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, চলতি বছর যে পরিমাণ কর্মী বিদেশে গেছে আগামী বছর এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর ১১ লাখ মানুষ গেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত যে অবস্থা আছে আমরা ধারণা করছি, ১২ লাখের ওপরে চলে যাবে। আমার বিশ্বাস, আগামী বছরও রেকর্ড হবে।

মন্ত্রী বলেন, আমাদের দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। আমরা দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। দক্ষ লোকই পাঠাতে হবে। সেটি কিছুটা হয়েছে, কিছুটা হয়নি। ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে বাড়তি নজর দিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ট্রেনিংয়ের সঙ্গে সরকারি ট্রেনিংয়ের মধ্যে সমন্বয় না হলে সমস্যা তৈরি হবে। আমাদের দক্ষ জনবল থাকলে সবাই আসবে জনবলের জন্য।

এনআই/এসএম