দেশের সবচেয়ে বড় অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর কোল ঘেঁষে রয়েছে রাজধানীর বৃহৎ বস্তিগুলোর একটি কড়াইল বস্তি। আশপাশের এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় আরো ১৫ বস্তি। এসব বস্তি আর গুলশান, বনানী, সেনানিবাস ও ভাসানটেকের কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসন।

একদিকে দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা অন্যদিকে বস্তির প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অভিজাতদের চাওয়া-প্রত্যাশা এক রকমের আর বস্তিবাসীর চাহিদা-প্রত্যাশা আরেক রকমের। এ আসনে তাই নানান হিসাব মেলাতে হচ্ছে প্রার্থীদের। 

স্থানীয়দের মতে, গুলশান-বনানীর যেকোনো নির্বাচনেই এ অঞ্চলের বস্তিগুলোতে বসবাস করা ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদের বড় অংশই সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। ফলে এ জনগোষ্ঠীর ভোট আদায় করে নেওয়া সবার জন্য কঠিন। তারা কাকে ভোট দেবে, তাদের প্রত্যাশা চাহিদা কারা পূরণ করতে পারবে— এমন নানান হিসাব মেলাতে হয় এখানকার প্রার্থীদের।

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকার এই আলোচিত আসনে প্রার্থী হয়েছেন ৭ জন। যার মধ্যে রয়েছেন- স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত আশওয়াদ ইসলাম (বেলুন মার্কা), ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) প্রার্থী এস এম আবুল কালাম আজাদ (টেলিভিশন মার্কা), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী কাজী শফিউল বাশার (সোনালী আঁশ মার্কা), বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত (নৌকা মার্কা), বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রার্থী মো. আইনুল হক (কুলা মার্কা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) প্রার্থী মো. গোলাম ফারুক মজনু (আম মার্কা) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রার্থী শাহ আলম (একতারা মার্কা)।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৭ আসন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ২৫ হাজার ১৮ জন। এর মধ্যে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৯১ হাজার ১৭৫ ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ভোটার রয়েছেন ৬০ হাজার ৮২৫ জন। এ ছাড়া, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৯ হাজার ৫৬২ জন, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৯ হাজার ৩২ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৪ হাজার ৪২৪ ভোটার। এসব ভোটারের বড় একটি অংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা বস্তিবাসী।

এ ছাড়া, এ আসনে থাকা বস্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মাটিকাটা বস্তি, বারনটেক বস্তি, বাইজারটেক বস্তি, সাগরিকা বস্তি, ভাসানটেক বস্তি, ধামালকোট বস্তি, শাহাজাদপুর ঝিলপাড় বস্তি, নর্দ্দা সরকারবাড়ী দুলাল বস্তি, কালাচাঁদপুর বস্তি, টিঅ্যান্ডটি বস্তি, রেললাইন বস্তি, কড়াইল বস্তি, গোডাউন বস্তি, ভাঙা দেয়াল বস্তি এরশাদনগর বস্তি এবং সাততলা বস্তি।

এ আসনের ভোটারদের প্রত্যাশা আসলে কী— তা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদকের। সেখানে অভিজাত এলাকার ভোটারদের এক রকমের প্রত্যাশা আর বস্তিবাসীদের আরেক রকমের চাহিদার কথা উঠে এসেছে। বস্তির বাসিন্দাদের প্রধান চাহিদা কর্ম বা চাকরির ব্যবস্থা আর অভিজাতদের চাওয়ার মধ্যে আছে এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা।

গুলশান-১ নম্বর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা খাদেমুল হক বলেন, আমরা যারা গুলশান এলাকার বাসিন্দা তাদের সবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে। আমরা চাই— এবার এখানে এমন একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোক, যিনি ব্যবসাবান্ধব। তিনি যেমন ব্যবসায়ীদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করবেন তেমনি সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমঝোতা করে এলাকার ভেতরের রাস্তা, সড়ক বাতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। এমন প্রতিশ্রুতি যে প্রার্থী দেবেন, আমরা তাকেই ভোট দেব।

বনানী এলাকার বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের এই আসনে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের এক-দুজন ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীকেই চিনি না। তারা কেমন কী, তাও জানি না। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক না, সাধারণ নাগরিক। আমরা চাই একজন যোগ্য লোক এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোক। ঢাকা-১৭ একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন, রয়েছে কূটনৈতিক পাড়া। এখানে অভিজাত ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা বসবাস করে। এ ছাড়া অনেকগুলো বস্তি রয়েছে; সবমিলিয়ে নিরাপত্তা ঠিক রেখে সবকিছু যিনি সুন্দর করে সাজাতে পারবেন বলে মনে হবে আমরা তাকেই ভোট দেব।

কড়াইল বস্তির বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, কত জন প্রার্থী হয়েছে; তাদের ছবি কেবল পোস্টারেই দেখি। এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে কেউ ভোট চাইতেই আসেনি। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ, আমাদের দাবি একটাই— এখানকার গরীব অসহায় মানুষদের যিনি কাজের ব্যবস্থা করে দেবে আমরা তাকেই ভোট দেব। এই আসনে আমরা যারা বস্তিবাসী তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, আমাদের জন্য অর্থাৎ গরিব মানুষদের জন্য যিনি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেবেন তাকে ভোট দেব।

কড়াইল বস্তিতে রহিমের বাড়িতে ভাড়া থাকেন আনোয়ারা খাতুন নামের একজন। তিনি গুলশানের একটি বাড়িতে কাজ করেন।

আনোয়ারা খাতুন বলেন, আমার বাবা-মার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এই বস্তিতে থাকি। বিয়ে হওয়ার পরেও স্বামী-সন্তান নিয়ে এই বস্তিতেই থাকি। সেই হিসেবে আমি এই এলাকার ভোটার অনেক আগে থেকেই। আমাদের বস্তিতে মাঝে মধ্যেই গ্যাস থাকে না, লাইন কেটে দেয়, বৃষ্টি হলেই প্রতিটি গলিতে পানি জমে যায়। এ ছাড়া, মশা আর নোংরা পরিবেশের দুর্গন্ধের কারণে মাঝে মধ্যে থাকা যায় না। যেহেতু আমরা গরিব মানুষ তাই বস্তি ছাড়া ভালো জায়গায় গিয়ে থাকতেও পারি না। তাই আমাদের এসব সমস্যার সমাধান যে করে দেবে, তাকেই ভোট দেব।

পাশের টিএন্ডটি বস্তিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন একজন বাসিন্দা। তিনি যুবলীগের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি পদে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ঢাকা-১৭ আসন যেমন অভিজাত এলাকা ঠিক তেমনি এখানে প্রায় ১৫টি বস্তি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য ভোটার এই বস্তিবাসী। যারা কোনো দল করে না, তারা চায় সুবিধা। যে প্রার্থী তাদের সুবিধা দিতে পারবে, আশ্বস্ত করতে পারবে; তাকেই এরা ভোট দিবে। আর গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকার মানুষদের চাওয়া আরেক রকমের। তারা সিংহভাগ চায়— নিরাপত্তা, সৌন্দর্য, সুন্দর যোগাযোগ, ব্যবসায়িক নিরাপত্তাসহ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যে প্রার্থী থাকবে সে প্রার্থীকে তারা বেছে নিবে। তাই এই আসনে ভোটের হিসেব মেলানো কঠিন। অভিজাত শ্রেণি আর বস্তিবাসীর নানা ইকুয়েশন মিলিয়েই এই ঢাকা ১৭ আসন।

এএসএস/এমজে