বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী কিংবা যে কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের ফাঁদে ফেলে (হানি ট্র্যাপ) ব্ল্যাক-মেইল করে আসছিল একটি চক্র। এ চক্রের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক নাগরিক জড়িত। তারাই বাংলাদেশি এজেন্টদের ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, চক্রটি টার্গেট করা ব্যক্তিদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার সময় তাদের অজান্তে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাক-মেইল করত এবং অর্থ হাতিয়ে নিত।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (দক্ষিণ) ফিন্যান্সিয়াল অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি মো. সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে এক অভিযানে এই চক্রের দুইজনকে গ্রেপ্তার ও নানা অপরাধের সন্ধান পায় ডিবি।

এ ধরনের একটি ঘটনার ভিকটিম থেকে ডিবি জানতে পারে, চলতি বছর তার ফেসবুক আইডিতে দিপীকা আগাঁরওয়াল নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে যা তিনি এক্সসেপ্ট করেন। উভয়ের মধ্যে পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে উভয় ঘনিষ্ঠ হয়ে নিয়মিত ভিডিও কলে কথা বার্তা বলতেন।

ম্যাসেঞ্জারে ও হোয়াটস্অ্যাপে ভিডিও কলে কথা বলার সময় বাদীর অজান্তেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশকিছু অশ্লীল, আপত্তিকর স্থিরচিত্র এবং ভিডিও-চিত্র দিপীকা আগারওয়াল নামে ওই নারী তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় গোপনে ধারণ করেন।

১ সেপ্টেম্বর দিপীকার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে বাদীর ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশকিছু স্থিরচিত্র এবং ভিডিও চিত্র পাঠানো হয়। যেখানে বাদীর ছবি এডিট করে নগ্ন অবস্থায় ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি দেয়। বাদী এসব ছবি ও ভিডিও ডিলিট করার জন্য অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে এসব ছবি ও ভিডিও ডিলিট করার জন্য ১ লাখ টাকা দাবি করেন ওই নারী। বাদী এতো টাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন না জানালে ২৫ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। অবশেষে বিভিন্ন বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে প্রতারকের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৭ হাজার টাকা পাঠান ভুক্তভোগী। এ ঘটনায় ডিবির কাছে অভিযোগ করলে গত ২০ ডিসেম্বর বনানীর কড়াইল এলাকা থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায় এ অপরাধের নানা রহস্য।

গ্রেপ্তার দুইজনই কলেজ শিক্ষার্থী

গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তরা হলেন, মো. টিপু সুলতান ও মো. মোসলেম রানা।

ডিবির তদন্তে জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া টিপু সুলতান হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের বিবিএ ৩য় বর্ষে এবং মোসলেম রানা তিতুমীর কলেজে স্নাতক (ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং) বিষয়ে তিতুমীর কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাদের দুইজনই ঢাকার কড়াইলে বসবাস করেন। 

বাংলাদেশি এজেন্টদের ভূমিকা

ডিবি জানায়, গ্রেপ্তার দুইজন বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া পুরুষদের টার্গেট করে এবং ফেসবুকে মেয়ে নামধারী কোনো ফেক আইডি থেকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। টার্গেট করা ব্যক্তি রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ভিডিও কলে কথা বলে এবং এক পর্যায়ে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে রাখে। এসব ছবি ও ভিডিও ভিকটিমকে পাঠিয়ে টাকা দাবি করত। টাকা দিতে না পারলে এসব ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাত। তাদের সঙ্গে কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকও জড়িত আছে।

চক্রের মাস্টার-মাইন্ড ভারতের শাকিল

ডিবি জানায়, এই প্রতারক চক্রের মাস্টার-মাইন্ড শাকিল নামে এক ভারতীয় নাগরিক। তিনি লোন অ্যাপস থেকে লোন গ্রহীতাদের লোন পরিশোধের জন্য এবং ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে অশ্লীল, ন্যুড ছবি ও ভিডিও ধারণ পূর্বক ব্ল্যাইকমেইলিং করে ভিকটিমদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য ভুয়া ইউপিআই (ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস) তৈরি করে দেয় বাংলাদেশি এজেন্ট টিপুকে। টিপু ইউপিআই পাঠায় পাকিস্তানি এজন্টে পারভজকে। পারভেজ ভিকটিমদের কল দিয়ে/ব্ল্যাক-মেইল করে টাকা আদায় করে। এছাড়াও নগদ/বিকাশের মাধ্যমে ভিকটিমদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে মূল হোতা ভারতের শাকিলকে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে বাংলাদেশি এজেন্ট প্রায় ২৫% এবং পাকিস্তানি এজেন্ট প্রায় ২৫% অর্থ পায়। সেই টাকা পরবর্তীতে বাংলাদেশি এজন্টে হয়ে ভারতে চলে যায় এবং বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি এজেন্ট তাদের নিজ নিজ কমিশন পেয়ে যায়। 

যেভাবে শিক্ষার্থী থেকে প্রতারক

ডিবি জানায়, দুই শিক্ষার্থী একই এলাকায় বসবাস করার সুবাদে পরস্পর পরিচিত। তারা অল্প সময়ে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় মূলত এ প্রতারণায় যুক্ত হন। তাদের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকদের পরিচয়ের পর তাদের প্রলোভনে এবং সহায়তায় আসামিরা এ কাজে যুক্ত হয়। গ্রেপ্তার মোসলেম রানা ভারতীয় চক্রের বাংলাদেশি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তার বিকাশ নম্বরে ভিকটিমদের কাছ থেকে আদায় করা ব্ল্যাক-মেইলের টাকা আসত। সেই টাকার একটা অংশ পরবর্তীতে ভারতীয় অ্যাকাউন্টে পাঠানো হতো।

ডিবি জানায়, এ ধরনের অপরাধ থেকে বাঁচতে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এআর/এসকেডি