নির্বাচনের পর ‘আরব বসন্তে’র ঝুঁকি কতটা বাস্তব কতটা জুজু?
চলতি বছরের প্রায় পুরোটা সময় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেক কথা বলেছে। ঢাকায় সরব ছিলেন তাদের কূটনীতিকরাও। তবে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এসে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ‘আলোচিত’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপও নেই আগের মতো।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অন্য কূটনীতিকদের নীরব অবস্থানের মধ্যেই বাংলাদেশে সম্ভাব্য ‘আরব বসন্তে’র মতো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ঝুঁকির কথা বলছে রাশিয়া। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্পর্ক আছে বলেও মনে করছে মস্কো।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে রাশিয়ার এমন বিবৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আগ বাড়িয়ে রাশিয়ার এ বিবৃতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রকে ‘খোঁচা’ দেওয়ার জন্য নাকি এতে অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তাদের? কিংবা সত্যি সত্যিই সেরকম কিছু ‘ঘটানো’ হতে পারে বলে রাশিয়ানদের হাতে কি কোনো ‘শক্ত’ গোপন বার্তা আছে? এসব নিয়ে নানামুখী আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে।
আরও পড়ুন
পশ্চিমা একটি দেশে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের সাবেক এক কূটনীতিক বলছেন, বাংলাদেশে আরব বসন্ত নিয়ে রাশিয়ার যে মেজারমেন্ট, এটা ফেইল করবে (ব্যর্থ হবে)। তবে এটাকে একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া যাবে না বা দরকার নেই, তাও নয়। গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, রাশিয়ার ইনটেলিজেন্স একটা খবর দিলে তা একেবারে ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও কর্মকাণ্ডে নজর রাখে।
ঢাকার আরেক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে রাশিয়া এ ধরনের বিবৃতি কেন দিল তা বড় প্রশ্ন। তারা আসলেই এমন কিছু পেয়েছে নাকি এখানে অন্য কোনো ‘হিডেন ডিপ্লোমেসি’ আছে? এটা জানার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় পাল্টা জবাব হিসেবে রাশিয়াকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন ঢাকার অন্য এক কূটনীতিক। তিনি বলেন, আমার মনে হয় না বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে রাশিয়ার খুব বেশি আগ্রহ আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে, রাশিয়া তার উল্টো দিকে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের পদক্ষেপের কাউন্টার হিসেবে রাশিয়ার এখনকার অবস্থান বিবেচনা করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের এবারের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন অনেক আগে থেকে সরব। ওয়াশিংটন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়ে অব্যাহতভাবে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। একই ইস্যুতে রাশিয়া একেবারেই বসে আছে এমন নয়। মস্কোর সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
ওয়াশিংটন যা বলছে তার বিপরীত অবস্থানে মস্কো। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ নিয়ে ঢাকায় রুশ দূতাবাস ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে মস্কো যে বিবৃতি দিয়েছে, তা আগের বিবৃতি বা বক্তব্যের তুলনায় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে।
নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে রাশিয়ার এমন বিবৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আগ বাড়িয়ে রাশিয়ার এ বিবৃতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রকে ‘খোঁচা’ দেওয়ার জন্য নাকি এতে অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কূটনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তাদের? কিংবা সত্যি সত্যিই সেরকম কিছু ‘ঘটানো’ হতে পারে বলে রাশিয়ানদের হাতে কি কোনো ‘শক্ত’ গোপন বার্তা আছে? এসব নিয়ে নানামুখী আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে
গত ১৫ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ বিষয়ে এক বিবৃতি দেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ভোটের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্তোষজনক মনে না হলে ‘আরব বসন্তে’র মতো করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হতে পারে। এমন আশঙ্কার গুরুতর ভিত্তি রয়েছে যে, আগামী সপ্তাহগুলোয় পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষে অসুবিধাজনক বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকমের অবরোধ আরোপ করা হতে পারে।
বিবৃতিতে বাংলাদেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর ওপর আঘাত আসতে পারে। সেই সঙ্গে কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক রায় প্রদানে বাধাদানের তথ্যপ্রমাণহীন অভিযোগ তুলে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত হবে, এমন সম্ভাবনা কম বলেও রাশিয়া মনে করছে বলে জানান মারিয়া জাখারোভা।
রুশ মুখপাত্রের বিবৃতির দুই দিন পর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। জবাবে মোমেন বাংলাদেশে আরব বসন্তের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া কী বলেছে, এটা আমাদের ইস্যু নয়। অনেকে অনেক ধরনের কথা বলবে, আমরা এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে, আমার মনে হয় না বাংলাদেশে আরব বসন্তের কোনো সম্ভাবনা আছে।’
আরও পড়ুন
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতি নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কিংবা ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছে উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশি হস্তক্ষেপের সঙ্গে হিসেব করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখানে (বাংলাদেশে) যুক্ত হয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে মার্কিন উপস্থিতি নেই। মার্কিন আধিপত্য ভারত মহাসাগরের অঞ্চলগুলোতে বজায় রাখতে হলে এখানে তার কিছু বন্ধু-রাষ্ট্রের প্রয়োজন। সেই বন্ধু-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে তারা। সেজন্য বাংলাদেশ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আবদুর রশীদ বলেন, রাশিয়া সেই অর্থে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় পাল্টা জবাব হিসেবে রাশিয়াকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে রাশিয়া তার উল্টোদিকে। বাংলাদেশে আরব বসন্ত নিয়ে মস্কোর বার্তাকে একেবারে ফেলে দেওয়ার সুযোগ নাই। আবার এমনটা ঘটবে এটাও ভাবা ঠিক হবে না। তবে রাশিয়ার ইনটেলিজেন্স একটা তথ্য দিয়েছে, এটাকে গুরত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আরব বসন্তের মতো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে নামেনি রাশিয়া। তবে, তারা (পশ্চিমারা) কী করেছে, আর কী করতে পারে; সেটা আমরা (রাশিয়া) তুলে ধরেছি।
আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি বলেন, রুশ মুখপাত্র তার ডিসেম্বরের বিবৃতিতে ১০ বছর আগে ইউক্রেনে যা ঘটেছিল, তার সঙ্গে ঢাকায় এখন যা ঘটছে, তার তুলনা করেছেন। তারা (ইউক্রেনে) নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছিল।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাশিয়া-চীন আমাদের এখানে সরাসরি খেলা খেলছে না। তাদের খেলাটা হলো— যখনই সুযোগ পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খোঁচা দেওয়া। কখনো সত্যিকারের কিছু ঘটনা দিয়ে আবার কখনও কিছু বিষয়ে অতিরঞ্জন করে। সুতরাং ওদের সব কথাকে বেদবাক্য মনে করার মতো কোনো কারণ নেই। মূলত, রুশরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পয়েন্ট বানাচ্ছে। আমাদের কিছুটা খুশি করা হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে খোঁচা মারা হচ্ছে।
এনআই/এমজে