শীতের রাতে ঘন কুয়াশার মধ্যেই অন্যদিনের মতো মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হুইসেল বাজিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছুটে চলেছে আন্তঃনগর ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (৭৯০)’ ট্রেন। ছিলেন ছয় শতাধিক যাত্রী। তাদের কেউ তখন ঘুমে, কারও দৃষ্টি খোলা। ট্রেন চালাচ্ছিলেন লোকোমাস্টার মো. ইমদাদুল হক ও সহকারী লোকোমাস্টার মো. সবুজ মিয়া। কিন্তু দুর্বৃত্তরা ‘গ্যাস কাটিং টর্চ’ দিয়ে রেললাইন কেটে রাখায় মুহূর্তেই সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

ঘটনাটি ১৩ ডিসেম্বর (বুধবার) গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়ার চিলাই ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার। সেদিন ভোর ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে ফেলায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ঘটনায় একজন নিহত ও ১০-১২ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ট্রেনের লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার। তারা বর্তমানে ঢাকার রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সেদিন এক হাজার ৫০০ অশ্বশক্তির ২৯০৭ নম্বর লোকোমোটিভ ১৪ কোচের মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস টেনে আনছিল। রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি যখন ভাওয়াল গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে, তখন সিগন্যাল লাইট দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ট্রেনটির লোকোমাস্টার মো. ইমদাদুল হক ও সহকারী লোকোমাস্টার মো. সবুজ মিয়া।

আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল, ঘন কুয়াশায় সামনের দিকে ১০-১৫ মিটারের বেশি দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ইমদাদুল হক ও মো. সবুজ মিয়া বুঝতে পারেন লোকোমোটিভের চাকা আর লাইনে নেই। বড় এক ঝাঁকুনিতে আঁতকে ওঠেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষেও দুর্ঘটনা এড়াতে পারেননি লোকোমাস্টাররা।

যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শী সহকারী লোকোমাস্টার

দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সহকারী লোকোমাস্টার মো. সবুজ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওই জিনিসটা আমি আর মনে করতেই চাচ্ছিলাম না। ওই রাতে প্রচুর কুয়াশা ছিল। সিগন্যাল দেখাটাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের (মানুষের) চোখের ভিজ্যুয়াল বেশি কিন্তু কুয়াশা এত বেশি ছিল যে ১০-১৫ মিটারের বেশি দেখা যাচ্ছিল না। ইঞ্জিন শর্ট হুডেই (সামনে মুখী) ছিল।’

‘পেছনে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে হয়। এগুলো ময়লাযুক্ত হওয়ায় ভিজ্যুয়াল আরও কমে যায়। রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে অলগ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ভাওয়াল গাজীপুর স্টেশনের আগে আমরা যখন স্টেশনের কাছাকাছি আসলাম, তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সিগন্যাল দেখার জন্য। একে তো স্টেশনের কাছাকাছি, আবার কুয়াশার কারণে সামনে বেশি দেখতে না পারায় গতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এমন সময় হঠাৎ লাইন থেকে চাকা পড়ে গেল।’

‘একটা বড় ঝাঁকুনি খেলাম। নিয়ম অনুযায়ী আমরা ব্রেক কষলাম। কিছুক্ষণ রোলিং করে যাওয়ার পর ইঞ্জিন বামদিকে কাত হয়ে যায়। হয়ত ওই জায়গায় মাটি নরম ছিল এবং জায়গাটা ঢালু ছিল। এমন সময় ইঞ্জিনটা আনব্যালেন্সড (নিয়ন্ত্রণহীন) হয়ে যায়। ইঞ্জিন আনব্যালেন্সড হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ঠিক ছিলাম। কিন্তু ইঞ্জিন আনব্যালেন্সড হওয়ার পর কোথায় আঁকড়ে ধরব, কীভাবে বাঁচব; এই সময়টা একটা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে গেছে। কিছু একটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। তারপর আর কিছু মনে নেই,’ বলেন এই সহকারী লোকোমাস্টার।

মো. সবুজ মিয়া বলেন, ‘ইঞ্জিন পুরোপুরি পড়ে থেমে যাওয়ার পর আমরা সেখানে অনেকক্ষণ পড়েছিলাম। এরপর আমি সোজা হলাম। দাঁড়িয়ে নিজেকে সুস্থ মনে হলো। তারপরও হাতেপায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাচ্ছিলাম।’

‘আমি দাঁড়ানোর পর লোকোমাস্টার সাহেবের খোঁজ নিলাম। দেখলাম, তিনি আমারও নিচে চলে গেছেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ঠিক আছেন তো? তিনি আমাকে জবাব দিলেন, ঠিক আছি। কিন্তু তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। কোমরে ব্যথা পেয়েছেন।’

‘এরপর আমি বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কোনো জায়গা আছে কি না। ততক্ষণে লোকজন চলে এসেছে। আমার সামনের দরজা ছিল মাটির নিচে। আর লোকোমাস্টার সাহেবের সামনের দরজা ছিল উপরে। লোকজন প্রথমে আমাকে উপরের দরজা দিয়ে কোনোমতে বের করেন। কিন্তু এমএল সাহেব উঠতে পারছিলেন না। তারপর আমি দরজা টান দিয়ে ধরে রাখি এবং একজন লোক তাকে টেনে বের করেন,’ যোগ করেন তিনি।

এমএইচএন/এসএসএইচ