গ্রিসে ২৫তম রোবট অলিম্পিয়াডে যাচ্ছে ছোট্ট ‘অলরাউন্ডার’ শামিল
এ বছর ষষ্ঠ বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই তাক লাগিয়ে দিয়েছে ছোট থেকেই ‘অলরাউন্ডার’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া খন্দকার শামিল মাহাদী বিন খালিদ। ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে রৌপ্য পদক ছিনিয়ে এনেছে সে। টিভির রিমোট ভেঙে ভেতরের সার্কিট পরীক্ষা করার জন্য যে ছেলেটি বকা খেত, সেই শামিল যাচ্ছে বিশ্বমঞ্চে। যেখানে নিজের তৈরি করা রোবট প্রদর্শন করবে সে।
২৫তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জাতীয় টিমের জন্য তাকে নির্বাচন করা হয়েছে। আগামী বছরের ১৪-১৬ জানুয়ারি গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত হবে এ প্রতিযোগিতা।
বিজ্ঞাপন
ও লেভেলে পড়া শামিলের আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বাবা খালিদ হোসেন সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষক ও মা শিরিন আক্তার জাহান পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) অতিরিক্ত ডিআইজি। পেশাগত কারণে বাবা-মা ব্যস্ত থাকায় ছোট শামিল নিজেকে ডুবিয়ে রাখত বইয়ের জগতে। নিজের চেষ্টায় কারো সহায়তা ছাড়াই নিজেকে ইংরেজি ভাষায় অসাধারণভাবে দক্ষ করে তোলে। তাকে ডাকা হতো জীবন্ত ডিকশনারি। তবে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র হলেও ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় ছিল সমান পারদর্শিতা।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে সে পড়ত জীবনানন্দ দাশের কবিতা। বইপড়ার নেশা থেকে তার মধ্যে বাড়তে থাকে জ্ঞানের তৃষ্ণা। প্রতিদিন শামিলের কিছু না কিছু শিখতেই হবে, কিছু না কিছু একটা পড়তে হবে।
৮ বছর বয়সেই নিজে নিজে প্রোগ্রামিং করা শেখে সে। ৯ বছর বয়স থেকে সে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করা শুরু করে। নিজেই শিখে ফেলে কীভাবে আর্ডুইনো দিয়ে বানাতে হয় রোবট। সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে ইউটিউব দেখে শিখে নেয় ক্যালকুলাস।
সুপ্ত মেধার প্রথম প্রকাশ বয়স যখন ১০
সুপ্ত মেধার নিদর্শন শিশুকাল থেকে পাওয়া গেলেও তার প্রকাশ প্রথম ঘটে যখন শামিলের বয়স ১০ বছর। তার স্কুলে জাতীয় ইংরেজি অলিম্পিয়াডের একটি রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পর্যায়ের জন্য সে নির্বাচিত হয়। পুরস্কার না জিতলেও, সেখান থেকে তার ভেতরে জন্ম নেয় নিজেকে প্রমাণ করার অদম্য ইচ্ছা। এরপর জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে প্রথমবারেই পৌঁছে যায় জাতীয় পর্যায়ে। নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে থাকে গণিত অলিম্পিয়াডেও। অ্যাকাডেমিয়ায় অনুষ্ঠিত ইংলিশ মিডিয়াম ম্যাথ অলিম্পিয়াডে সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিখ্যাত ওয়ার্ল্ড স্কলারস কাপের ঢাকা রাউন্ড। সেখানে অংশগ্রহণ করে টিম ডিবেট, স্কলারস চ্যালেঞ্জ ও কলাবরেটিভ রাইটিং। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে সে সাতটি স্বর্ণপদক ও তিনটি রৌপ্যপদক অর্জন করে। তাকে নির্বাচন করা হয় থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল রাউন্ডের জন্য। সমগ্র এশিয়া মহাদেশ থেকে তুখোড় স্কলাররা এসে ভিড় জমায় সেখানে। তাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা করে সে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে অর্জন করে তিনটি স্বর্ণপদক ও আটটি রৌপ্যপদক। তাকে নির্বাচিত করা হয় আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্ট অব চ্যাম্পিয়নস রাউন্ডের জন্যে।
সরকারি চাকরিজীবী বাবা-মা ছুটি না পাওয়ায় শামিল একাই যায় আমেরিকায় ইভেন্টে অংশগ্রহণের জন্য। সেখানেও ছিনিয়ে আনে সিনিয়র ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের একমাত্র ট্রফি।
ছোটবেলায় পড়া অজস্র দস্তোয়েভস্কির উপন্যাস ও জীবনানন্দের কবিতার চিন্তা-চেতনার প্রকাশ পায় তার কলাবরেটিভ রাইটিংয়ে লেখা রচনায়, যা সারা বিশ্বের মধ্যে নবম স্থান অধিকার করে। শুধু ট্রফি নয়, ৬৫ দেশের স্কলারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সে অর্জন করে তিনটি স্বর্ণপদক ও দুইটি রৌপ্যপদক।
শুধু তাই নয়, এ বছর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে প্রথমবারেই ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে অর্জন করে রৌপ্যপদক। সে নির্বাচিত হয়েছে ২৫তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জাতীয় টিমের জন্যে।
এ ব্যাপারে শামিলের মা এটিইউয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি শিরিন আক্তার জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দেশকে সে গর্বিত করতে চায়। শুধু খাতা-কলমে-মেডেলে নয়, সে চায় সরাসরি দেশের উন্নতি করতে। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ডিপিএস, এসটিএস স্কুলে আয়োজিত জিওউইক প্রতিযোগিতায় পরিবেশ দূষণ নিয়ে সে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে অর্জন করে তৃতীয় স্থান। তার ডকুমেন্টারি সবার নজর কাড়ে। সেখান থেকেই সবাই পরিচয় পায় তার দূরদর্শী ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার।
তিনি বলেন, শামিলের ইচ্ছা ভবিষ্যতে দুনিয়ায় স্টেমের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ আমেরিকার এমআইটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। বিদেশে পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকলেও, প্রবাসী হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। শামিলের লক্ষ্য নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার পর ফিরে আসা এবং দেশের উন্নতিতে নিজেকে নিয়োজিত করা। এখন সমাজের অগ্রগতির শীর্ষে আছে প্রযুক্তি, আর প্রযুক্তির শীর্ষে আছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তাই শামিল চায় এমআইটিতে গবেষণা করে প্রিয় মাতৃভূমিতে যুগান্তকারী এই প্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞান নিয়ে এসে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে নিতে।
জেইউ/কেএ