দেখতে দেখতে কৈশোর পেরিয়ে ২০তম বছরে পা রাখল রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের একমাত্র প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন দিকে সক্ষমতা বাড়লেও দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সংস্থাটির আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে প্রথম কমিশনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর যথাক্রমে সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, গোলাম রহমান, মো. বদিউজ্জামান ও ইকবাল মাহমুদের পর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।

মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনের মেয়াদ আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধান অনেক। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতাশ করেছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর আসামি গ্রেপ্তার থেকে একেবারেই পিছু হটেছে দুদকের বর্তমান কমিশন।

বর্তমান কমিশনের মেয়াদের তিন বছরের পরিসংখ্যান তুলনা করলে এসব চিত্র উঠে আসে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৩০৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ে মাত্র ১৯৬টি মামলা হয়। কিন্তু ৯ মাসেই পরিসমাপ্তি বা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৫৯টি অভিযোগ। যা ২০২২ ও ২০২১ সালের ১১ মাসের পরিসংখ্যান বিবেচনা নিলেও প্রায় দ্বিগুণ। একই সময়ে ২৪৭টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। অন্যদিকে ৫৫টি মামলার চার্জশিট না দিয়ে এফআরটির (মামলা থেকে অব্যাহতি) মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।

২০২২ ও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৩১২টি ও ২৪৪টি অভিযোগ পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ওইসব অভিযোগে দুর্নীতি খুঁজে পায়নি দুদক অনুসন্ধান বিভাগ।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দুদকের বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৩৫৪টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়। ওইসব অভিযোগে মামলা দায়ের হয় ২৭৬টি। ওই সময় ৩১২টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়। ১৬২টি মামলার চার্জশিট দিয়েছিল দুদক। আর ৭৮টি মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩২৬টি দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। একই সময়ে ৩১১টি দুর্নীতির মামলা হয়। ওই সময় ২৪৪টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়। তদন্ত শেষে ২২২টি মামলার চার্জশিট দায়ের হয়। এফআরটি (মামলা থেকে অব্যাহতি) হয়েছিল ৮০টি মামলার।

চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ৩০৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ে মাত্র ১৯৬টি মামলা হয়। কিন্তু ৯ মাসেই পরিসমাপ্তি বা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৫৯টি অভিযোগ। যা ২০২২ ও ২০২১ সালের ১১ মাসের পরিসংখ্যান বিবেচনা নিলেও প্রায় দ্বিগুণ।

আর গত তিন বছরে দুর্নীতির মামলার আসামি গ্রেপ্তারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা দিতে পারেনি দুদক। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের পাঁচ বছরে প্রতিবছর গড়ে শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার করার নজির সৃষ্টি করেছিল। অথচ গত ১৯ বছরে দুদকের বিভিন্ন দিকে সক্ষমতা বাড়লেও সেই তুলনায় দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড বাড়েনি।

সার্বিক বিষয়ে সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে কেবল কমিশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

এদিকে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চলতি বছরের গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) দায়ের হওয়া ১৯৬টি মামলায় ৩৭৪ জনকে আসামি করা হয়। এতে ১৮৭ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও তালিকায় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ১০ জন। এছাড়া ৭০ জন বেসরকারি চাকরিজীবী, ৩০ জন ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার ৭৬ জনকে আসামি করেছে দুদক।

অপরদিকে গত ৯ মাসে দাখিল হওয়া ২৪২টি অভিযোগপত্রে ১ হাজার ১২৪ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৬৮৯ জনই সরকারি চাকরিজীবী। দাখিল করা অভিযোগপত্রে বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৮৯ জন, ৮১ জন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ৬১ এবং ৯ জন জনপ্রতিনিধি এবং অন্যান্য পেশার ৯৭ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুদকের জালে আটকে পড়া রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধির সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। অর্থাৎ সমাজে যারা দুর্নীতিবাজ বলে বেশি পরিচিত তাদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি দুদকের বর্তমান কমিশন।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা আসলে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত; বিশেষ করে যারা রাজনৈতিকভাবে ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাদের রুই-কাতলা বলা হয়। তাদের ক্ষেত্রে দুদককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তারা মূলত যারা চুনোপুঁটি তাদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে। দুদক এখন রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রভাবিত হয়। যারা প্রভাবশালী তাদের ধরতে সাহস দেখায় না। দুদক কী ক্রমাগতভাবে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটা যতখানি না কমিশনের হাতে, তার থেকে বেশি প্রশাসনের হাতে। দেশের দুর্নীতি দমনে দুদককে সমস্ত প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে কাজ করতে হবে।

আরএম/এসকেডি