মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস / ফাইল ছবি

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংলাপের উদ্যোগসহ নানামুখী ভূমিকায় বেশ আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তবে তফসিল ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) পিটার হাসের ‘হঠাৎ’ বিদেশযাত্রা সেই আলোচনায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। তফসিল কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বোদ্ধামহল— সবখানে এখন আলোচনায় পিটার হাস। মার্কিন এই দূতের ঢাকা ত্যাগ এখন ‘টক অব দ্য টাউন'।

দুপুরে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে কলম্বো গেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। ছুটি নিয়ে দেশটিতে অবকাশ যাপনে যাওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সঙ্গে তার সহধর্মিণী রয়েছেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে নির্বাচন ঘিরে কয়েকমাস ধরে আলোচনায় থাকা পিটার কেন হঠাৎ ছুটিতে কলম্বোয় যেতে হবে, তা নিয়েও বিভিন্ন সমীকরণ মেলাচ্ছেন কেউ কেউ।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করলেও এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। অবশ্য ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের একটি সূত্র জানায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সস্ত্রীক শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উদ্দেশে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা ছেড়ে গেছেন।

আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কোথায় গেছেন, সেটা সরকার জানে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানের ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হবে না।

মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তারা যখন স্টেশন ত্যাগ করেন, তা কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়। আবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরাও যখন স্টেশন ত্যাগ করেন, তখন যে দেশে কাজ করেন; সেখানে জানান।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ‘অ্যাসাইনমেন্টে’ ফিরবেন পিটার হাস।

চলতি বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অব্যাহত বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন যে বার্তাই দিক সেগুলো ছাপিয়ে দেশটির রাষ্ট্রদূত হাসের গতিবিধি যেন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তিনি কখন, কোথায় যাচ্ছেন; কাদের সঙ্গে বসছেন এবং কী বলছেন— তা নিয়ে মানুষের আগ্রহও বেশ।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ছুটিতে ঢাকার বাইরে যাওয়াকে সারাদিন যে আলোচনা বা গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছেন সাবেক কূটনীতিকরা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে পশ্চিমা গুরত্বপূর্ণ একটি দেশে দূতের দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের দেশে এ অনুশীলন চলছে। বিদেশি কিছু দেশের রাষ্ট্রদূতদের আমরা মসিহ’র স্থানে বসাচ্ছি। অথচ অন্য কোনো দেশে এসব হয় না। রাষ্ট্রদূতের এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তারা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। এর দায় যেমন রাজনীতিবিদদের ওপর বর্তায় তেমনি গণমাধ্যমেরও যথেষ্ট দায় রয়েছে। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার (পিটার) হয়তো কোনো প্রয়োজন রয়েছে, সেজন্য শ্রীলঙ্কায় গেছে। সেটা নিয়ে আমরা এত অস্থির হচ্ছি কেন? তারা এ ঘর থেকে ওই ঘরে গেলে, হাতমুখ ধুতে গেলেও আমরা যদি অস্থির হয়ে যাই, তাহলে খুব মুশকিল। এ দোষটা আমাদের। তাদের সেই সুযোগ করে দেই। আর তারা যখন দেখে গুরুত্ব পাচ্ছে, তারাও মজা পান। আমরা জানি না সে কী জন্য গেছে। কিন্তু এটার সঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের কোনো সম্পর্ক আছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নাই।

‘আমাদের দেশের অনেক অনেক বড় বিষয় রয়ে গেছে। সেগুলো বাদ দিয়ে একে (পিটার) নিয়ে এত অস্থির হয়ে যাচ্ছি কেন?’ প্রশ্ন রাখেন সাবেক এ রাষ্ট্রদূত।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে চলমান আলোচনাকে বাড়াবাড়ি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। তার ভাষ্য, একজন রাষ্ট্রদূত ছুটিতে যাবেন। তার প্রয়োজনে দেশে যেতে পারেন, অন্য দেশেও যেতে পারেন। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের এত ব্যস্ত হয়ে পড়ার তো কিছু দেখছি না। এটাকে বাড়াবাড়ি ছাড়া আমি আরও কিছুই বলতে চাইছি না।

দুদিন আগে বাংলাদেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। যার দূতিয়ালির দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্রদূত পিটার। লু’র লেখা সংলাপের চিঠি গত সোমবার (১৩ নভেম্বর) পিটার হাস নিজে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের হাতে পৌঁছে দেন। সেই চিঠি বিএনপিও হাতে পায়। তবে বিএনপিকে দূতাবাসের পক্ষে কে বা কারা চিঠি পৌঁছে দেন, তা জানা যায়নি।

এর দুদিন পর গতকাল (বুধবার) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাছে সংলাপের চিঠি হস্তান্তর করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তবে যে উদ্দেশে ওয়াশিংটন চিঠি দিয়েছে, তাতে গুরত্ব দেয়নি ক্ষমতাসীনরা। কেননা, দলটির সাধারণ সম্পাদক চিঠি হাতে পেয়ে গণমাধ্যমকে জানান, এখন আর সংলাপ করার কোনো সুযোগ নাই।

ওইদিন সন্ধ্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সিইসি জানিয়ে দেন, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সমাবেশ করে। সমাবেশ কেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতার পর অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয় দলগুলো। বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যেও ঢাকায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-গত ৩১ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক। এরপর গত ২ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক রাজনৈতিক মহলে বেশ গুরুত্ব পায়। সর্বশেষ, প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে হওয়া পিটার হাসের বৈঠকটি ছিল বেশ আলোচনাপূর্ণ। এর আগে, ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

১৫ দিনের ব্যবধানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুরুত্বপূর্ণ ওই চারটি বৈঠকের মধ্যে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে হওয়া বৈঠকটি সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবহিত হয়েছেন। কারণ, উভয়পক্ষ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাকি তিনটি বৈঠক নিয়ে কোনো পক্ষই গণমাধ্যমে মুখ খোলেননি। ফলে সাধারণ ও সচেতন জনগণও কিছু জানতে পারেননি।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারের স্থলাভিষিক্ত হয়ে গত বছরের মার্চের শুরুতে ঢাকায় আসেন পিটার হাস। ওই বছরের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন তিনি।

২০২১ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশে পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে পিটার হাসকে নিয়োগের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন সিনেট তার মনোনয়ন চূড়ান্ত করে।

মার্কিন কংগ্রেসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পিটার ডি হাস যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা। তিনি একজন পেশাদার কূটনীতিক ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পিটার ডি হাস ঢাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পাওয়ার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার আগে তিনি বাণিজ্য নীতি ও সমঝোতা বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এনআই/এসএম