বাবা জালাল উদ্দিন সুস্থ হলে কোলে চড়ে বাসায় ফিরতে চেয়েছিল তার নয় বছর বয়সী মেয়ে জান্নাতুল বাকি মরিয়ম। কিন্তু জান্নাতুলের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর তিনদিনের লড়াই শেষে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন গার্মেন্টস শ্রমিক জালাল উদ্দিন।

রোববার (১২ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের সামনে জালাল উদ্দিনের স্ত্রী নার্গিস পারভিনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। এসময় কাঁদতে কাঁদতে এ কথা জানান তিনি। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। এখন তো আমার কিছুই রইল না। আমি এখন কী নিয়ে থাকব। আমার স্বামীকে ওরা গুলি করে মারল। আমার স্বামী তো আওয়ামী লীগ করত। বুধবার (৮ নভেম্বর) আমি আমার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে ছিলাম, সেখান থেকে খবর পেলাম আমার স্বামীকে পুলিশে গুলি করায় সে আহত হয়েছে। পরে সেখান থেকে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

‘খবর পেয়ে আমি সেই হাসপাতালে যাই। তারা বলল— এখানে চিকিৎসা হবে না, ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমার স্বামীর পেটে একশোর বেশি গুলি লেগেছে। পরে সেদিনই তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। আমার স্বামী ইসলাম গার্মেন্টসে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করত। শুক্রবার সকালে তাকে আইসিইউতেকে নেওয়া হয়। গতকাল রাতে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার স্বামী মারা যায়।’

‘আমার স্বামীকে তারা হত্যা করল এই দায় কে নেবে? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমি এখন আমার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কী করব, কীভাবে চলব। আমার মেয়ে জান্নাতুল চেয়েছিল সুস্থ হলে বাবার কোলে চড়ে বাসায় যাবে। কিন্তু আর কোনোদিন তার বাবার কোলে ওঠা হবে না।’

মায়ের কান্না দেখে নয় বছরের শিশু জান্নাতুলও কান্না করছিল আর বারবার চোখ মুছছিল। মায়ের কান্না দেখে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল জান্নাতুল। মরিয়ম এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

নিহত গার্মেন্টস শ্রমিক জালাল উদ্দিন (ছবি : সংগৃহীত)

নিহতের বড় ভাই সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চার ভাই তিন বোন। জালাল উদ্দিন ছিল তৃতীয়। সে ইসলাম গার্মেন্টসে চাকরি করত। আমি বাড়িতে ছিলাম। আমি খবর পাই পুলিশ আমার ভাইকে গুলি করেছে। খবর পেয়ে আমি ঢাকায় এসে দেখি আমার ভাইয়ের পেটে একশ’র বেশি সীসা বুলেট লেগেছে। কাছ থেকে গুলি লাগায় তার পেটের ভেতরে গুলি ঢুকে যায়। অপারেশনের পর অবস্থা খারাপ হলে তাকে চিকিৎসক আইসিইউতে রেফার্ড করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই মারা যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমার ভাই তো কোনো দোষ করেনি, তাহলে তাকে কেন গুলি করে মারতে হবে। আমার ভাইয়ের একটাই মেয়ে ছিল। এখন তার কী হবে? তাদের তো উপার্জনক্ষম আর কেউই রইল না। মেয়েটার ভবিষ্যৎ তো অনিশ্চিত হয়ে গেল। আমার ভাইয়ের সংসারের দায়িত্ব এখন কে নেবে? আমার ভাতিজির পড়ালেখার খরচ এখন কীভাবে চলবে? যাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে, তাদেরকে এভাবে গুলি করে মারাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানা এলাকায়। আমার বাবার নাম মৃত চান মিয়া।’

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোনাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নীলকমল বলেন, ‘গুলিতে নিহত গার্মেন্টস শ্রমিক জালাল উদ্দিনের ময়নাতদন্ত চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায় জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করা হবে।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে গার্মেন্টস কর্মী জালাল উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। পরে গতকাল (শনিবার) রাত সাড়ে বারোটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে মারা যান তিনি। 

প্রসঙ্গত, সম্পতি ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। সেই ধারাবাহিকতায় পোশাক শ্রমিক ও মালিকপক্ষের ছয় দফা বৈঠক শেষে গত ৭ নভেম্বর ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। 

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এটা ঘোষণা করছি। ন্যূনতম মজুরি ৫৬.২৫ শতাংশ বাড়বে। আট হাজার টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা হবে। সঙ্গে বছরে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট থাকবে। ফলে এখন থেকে পোশাক কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের ন্যূনতম সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে।

জানা গেছে, গত ১ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের পঞ্চম সভায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৪ টাকা করার প্রস্তাব করেন শ্রমিকদের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি। অন্যদিকে, ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকার করার প্রস্তাব করেন পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই নতুন মজুরির ঘোষণা দেয় সরকার।

তবে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেন শ্রমিকরা। এরপর দাবি আদায়ে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা। তাদের আন্দোলন এখনো চলমান রয়েছে। 

এসএএ/কেএ