‘পাতাল ফেড়ে নামব নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে’
‘‘...পাতাল ফেড়ে নামব নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে/বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’’ —জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার লাইন দুটির মতোই যেন পাতাল জয়ের নেশায় মত্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তো তিনি বুকভরা সাহস নিয়ে হাত দিয়েছিলেন টানেল নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পে। যা নিয়ে শুরুতে অনেকের মধ্যেই ছিল সংশয়। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবশেষে আজ আলোর মুখ দেখছে বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।’
স্বপ্নের শুরু নদীর তলদেশ দিয়ে মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরির মধ্য দিয়ে। তারপর সেটি দিয়ে বানানো হলো সড়ক। সেই সড়ক দিয়েই এবার চলবে গাড়ি। এ যাত্রা হবে রোমাঞ্চকর। কারণ, নদীর ওপর বিশাল জলরাশিতে চলবে বড় বড় জাহাজ। আর তার নিচ দিয়ে টানেলে চলবে যানবাহন।
বিজ্ঞাপন
পাতালজয়ী প্রকল্প ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন হচ্ছে শনিবার (২৮ অক্টোবর)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম এসে এই মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর এই আগমন ঘিরে চট্টগ্রামে এখন সাজসাজ রব। বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো হয়েছে ব্যানার-পোস্টার। টানেল উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন জনসভায়। কর্ণফুলী থানার কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ এ জনসভার আয়োজন করছে। নেতাকর্মীরা জানান, মেগা প্রকল্প উপহার দেওয়ায় জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাবে চট্টগ্রামবাসী।
হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম যাবেন প্রধানমন্ত্রী
শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচির মধ্যে রয়েছে– সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে তিনি গণভবন থেকে তেঁজগাও বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবেন। সেখান থেকে ৯টা ৪৫ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি। ১০টা ৫৫ মিনিটে হেলিকপ্টার চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমিতে পৌঁছাবে। বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করবেন। এরপর টানেল দিয়ে আনোয়ারা পৌঁছে ১২টায় সমাবেশে যোগ দেবেন তিনি। দুপুর ২টায় জনসভা শেষ করে আবার টানেল হয়ে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি এসে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় রওনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধন হবে আরও ১৯ প্রকল্প
শনিবার টানেলের পাশাপাশি আরও ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে ১৬টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন ও তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।
জেলা প্রশাসন জানায়, এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু টানেল ছাড়াও চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, জেলা পরিষদ টাওয়ার, রাঙ্গুনিয়া ও আনোয়ারা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পটিয়ায় শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল, রাউজানে শেখ কামাল কমপ্লেক্স, আগ্রাবাদে সিজিএস কলোনিতে ৯টি বহুতল আবাসিক ভবন, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, শিকলবাহা খালের ওপর পিসি গার্ডার ব্রিজ, ডিসি পার্ক, হাজার বছরের নৌকা জাদুঘর, ১৯১টি ইউনিয়নে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্মার্ট স্কুল বাস সার্ভিস ও পর্যটক বাস, রিভার ক্রুজ ও ফুল ডে ট্যুর সম্বলিত পর্যটন সেবা, বার্ডস পার্ক ও চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণ প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করবেন।
আরও পড়ুন
এছাড়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সড়ক এবং সিমেন্স হোস্টেল কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পের।
নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকবে ২ হাজার পুলিশ
টানেলের এক প্রান্তে পতেঙ্গা থানা এবং অন্যপ্রান্তে কর্ণফুলী থানা। দুটি থানায় নগর পুলিশের বন্দর জোনের অধীনে। এই জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শেখ শরীফ উজ জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রায় ২ হাজার ফোর্স মোতায়েন করা হবে।
বন্দর জোনের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, টানেল উদ্বোধনের দিন যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত ২০০ ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
নৌকার আদলে মঞ্চ, ১০ লাখ জনসমাগমের আশা আওয়ামী লীগের
প্রধানমন্ত্রীর জনসভা উপলক্ষ্যে কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে নৌকার আদলে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ। মঞ্চ তৈরির কাজ প্রায় শেষ। ৪ হাজার ৬০৮ বর্গফুট আয়তনের এই মঞ্চে একসঙ্গে বসা যাবে ২৫০ জন। মঞ্চের সামনে ২৫ মিটার, ৩০ মিটার ও ৩৫ মিটার দূরত্বে বাঁশের ব্যারিকেড থাকবে। জনসভার মাইক আনা হয়েছে ঢাকার কলরেডি কোম্পানি থেকে। এছাড়া আটটি পয়েন্টে এলইডি স্ক্রিন লাগানো হয়েছে।
সমাবেশে ১০ লাখ লোকের জনসমাগমের আশা জানিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৮ অক্টোবর সকালে নেতাকর্মী ও জনসাধারণ ফজরের পর জনসভার উদ্দেশে রওনা দেবে। ৭টায় সমাবেশস্থল খুলে দেওয়া হবে। সমাবেশ উপলক্ষ্যে পুরো চট্টগ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নেতাকর্মীরা নেত্রীকে একনজর দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। আনুমানিক ৭ থেকে ১০ লাখ লোক সমাবেশে আসবে। সবকিছুর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, একসময় মানুষ মাটির নিচ দিয়ে গাড়িযোগে যাবে, এটা স্বপ্নের বিষয় ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে টানেলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা এখন লোকজনকে বলতে পারব, প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তা করেন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পকারখানা।
নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
এমআর/এসএসএইচ/