বঙ্গবন্ধু টানেল : বহির্বিশ্বে ইমেজ বাড়বে বাংলাদেশের
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই প্রথম নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেল। বাংলাদেশের সক্ষমতার আরেক উদাহরণ এই স্থাপনা। দেশের এই মেগা প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে টানেলযুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিজ্ঞাপন
চবি শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের মতে, টানেলের বাস্তবায়নের মধ্যে একটি টেকনোলজিক্যাল অ্যাচিভমেন্ট রয়েছে। আর তার সঙ্গে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার বিষয়। আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। একইসঙ্গে টানেল ও পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের জাতীয় ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দেশের উন্নতি কতটুকু সাধিত হয়েছে সেটির প্রতিচ্ছবি হচ্ছে এ ধরনের বড় বড় প্রকল্প।
আরও পড়ুন
‘টানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে একটি প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনীতির দেশ তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদি আমরা সেটি লোন নিয়েও করি তাও এটি সক্ষমতার প্রকাশ পায়। কারণ কোনো দেশ এখানে বিনিয়োগ করেছে, তারা তো নিজেদের অর্থ পানিতে ফেলে দেয়নি। তারা চিন্তা করেছে বাংলাদেশ এই টাকা আমাকে ফেরত দিতে পারবে। এজন্য হয়ত চীন এখানে বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা করেছে। কথা হচ্ছে চীন তো আর যেখানে-সেখানে গিয়ে টানেল বানিয়ে দিচ্ছে না। বাংলাদেশ তার উপযুক্ত বিধায় চীন এখানে টানেলের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে। তার মানে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন আমাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক।’
টানেল কীভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধি করেছে তার উদাহরণ দিয়ে চবি শিক্ষক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করছে। কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজন করে কাতার খুব বেশি আয় করতে পারেনি। এর থেকে বেশি টাকা তারা সেখানে খরচ করেছে। কিন্তু তারপরও তারা ওই আয়োজন কেন করেছিল? কারণ এ ধরনের একটি বড় আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম আয়োজন করে কাতার নিজেদের সক্ষমতা প্রকাশ করেছে। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, আমরা যখন ব্যক্তিগতভাবে একটু সচ্ছল হই, তাহলে ভালো দাম দিয়ে একটি স্যুট কিনি। ভালো ঘড়ি পড়ি কিংবা দামি জিনিস ব্যবহার করি। এগুলো আমরা কেন করি? নিজের আভিজাত্য এবং সক্ষমতা প্রকাশের জন্য করি। এ রকম টানেল এবং পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
টানেল বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করবে
চবি শিক্ষক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কক্সবাজার অদূর ভবিষ্যতে বিআইসিএম অর্থাৎ বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, চীন, মিয়ানমার করিডোর- যেটি চীনের সিল্ক রোড নামে পরিচিত সেটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আবার কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকা এবং উত্তরবঙ্গকে সহজে যুক্ত করেছে টানেল। চীনের সিল্ক রোড যেটিকে বলা হচ্ছে বেল্ট অ্যান্ড রোড, এটি টানেলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সহজে সংযুক্ত করছে। এভাবে চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে টানেলের মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক যোগাযোগ আরো সমৃদ্ধ হবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিভিন্ন ইকোনমিক জোন গড়ে উঠছে। সেখানে দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। এসব ইকোনমিক জোনের সঙ্গে বন্দরকেন্দ্রিক এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরকেন্দ্রিক যোগাযোগ বাড়বে। এই টানেল থেকে সরকার রেভিনিউ পাবে। একইসঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।
টানেলকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র করার পরামর্শ
চবি শিক্ষক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি চীনের সাংহাইয়ের আদলে টানেলটি করা হয়েছে। অর্থাৎ সাংহাইয়ের মতো চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি টু টাউন। চীনের সেই টানেলে আমি গিয়েছি। সেখানে আমি দেখেছি, সাংহাইয়ে টানেলকেন্দ্রিক একটি পর্যটন কেন্দ্র করা হয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীরা সেখানে যান। এতে করে তারা সেখান থেকে প্রচুর রাজস্ব পায়। আবার ওই পর্যটনকেন্দ্র এমনভাবে করা হয়েছে যেন টানেলে যান চলাচলে কোন সমস্যা না হয়। বাংলাদেশ সরকারও চাইলে কর্ণফুলী টানেলকেন্দ্রিক একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। সেটি পতেঙ্গা অথবা আনোয়ারা প্রান্তে হোক। তাহলে টানেলের পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আগামীকাল ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের উদ্বোধন করবেন। পরদিন থেকে জনসাধারণের যানচলাচলের জন্য টানেল খুলে দেওয়া হবে। এর ফলে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে ওঠবে নতুন শিল্পকারখানা।
নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসেবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
এমআর/এমজে