যেন রূপকথার গল্প। নদীর তলদেশ দিয়ে খনন করা হয়েছে সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গে বসেছে সড়ক। আবার সেই সড়ক দিয়ে চলছে গাড়ি। কীভাবে সম্ভব?

সুড়ঙ্গটি কীভাবে খনন করা হয়েছে, আবার সেখানে সড়ক-ই বা কীভাবে তৈরি করা হয়েছে, হঠাৎ সেটি ভেঙে পড়বে কি না, সুড়ঙ্গে পানি ঢুকবে কি না কিংবা নদীতে জাহাজ চললে চাপের কারণে টানেল ফেটে যাবে কি না— এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। তাদের কৌতূহলের যেন শেষ নেই।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক পাঠকদের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর জেনেছেন টানেলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হারুনুর রশিদ এবং নির্মাণের সঙ্গে জড়িত অন্য সহকারী প্রকৌশলীদের কাছে।

অনেকে মনে করেন, কর্ণফুলী নদীর পানির মাঝখান দিয়ে মনে হয় টানেলটি গেছে। তবে, প্রকৃতপক্ষে টানেলটি নদীর তলদেশের মাটি থেকে আরও নিচে। কোথাও ১৮ মিটার কোথাও তারও বেশি। সর্বোচ্চ ৩১ মিটার নিচ দিয়ে টানেল গেছে। এ কারণে নদীর পানির সঙ্গে এটির সম্পর্ক নেই

সুড়ঙ্গটি নদীর কয় ফুট নিচে?

অনেকে মনে করেন, কর্ণফুলী নদীর পানির মাঝখান দিয়ে মনে হয় টানেলটি গেছে। তবে, প্রকৃতপক্ষে টানেলটি নদীর তলদেশের মাটি থেকে আরও নিচে। কোথাও ১৮ মিটার কোথাও তারও বেশি। সর্বোচ্চ ৩১ মিটার নিচ দিয়ে টানেল গেছে। এ কারণে নদীর পানির সঙ্গে এটির সম্পর্ক নেই। 

সুড়ঙ্গ কীভাবে খনন করা হয়েছে?

টানেল খননে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে চীনের সাংহাই বন্দর থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে একটি টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)। প্রায় চারতলা ভবনের উচ্চতার সমান মেশিনটির ওজন প্রায় দুই হাজার ২০০ টন। ৯৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২ দশমিক ১২ মিটার ব্যাসের মেশিনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় বোরিং মেশিন। বাংলাদেশের জন্য চীনা কোম্পানি ‘টানহেং মেকানিক্যাল’ মেশিনটি তৈরি করে। মেশিনটি প্রথমে টানেলের পতেঙ্গা অংশে ৯৪ ফুট নিচে গর্ত খনন করে বসানো হয়।

টিবিএম মেশিনের ঠিক সামনে আছে ধারালো কাটার, যা মাটি কাটতে কাটতে এগিয়ে যায়। কাটার মেশিন যখন মাটি কাটে তখন সব মাটি ও পাথর একটি পাইপের মাধ্যমে আলাদা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে চলে যায়। পেছন দিক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কংক্রিটের একেকটি সেগমেন্ট ঢুকে চারদিকে গোলাকারের শক্ত দেয়াল তৈরি করে। ফলে মেশিন যত এগোয় ততই আকার পায় টানেল। এভাবে চার থেকে পাঁচ মিটার করে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়।

প্রথমে টিবিএম দুই হাজার ৪৫০ মিটার খনন করে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে একই পদ্ধতিতে আরেকটি সুড়ঙ্গ খনন করে টিবিএম মেশিন পতেঙ্গা প্রান্তে পৌঁছায়। এভাবে খনন হয় স্বপ্নের টানেল।

টানেলের নকশা তৈরির সময় ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় টানেলই সবচেয়ে নিরাপদ। ২০ মিটারের নিচের মাটিতে কম্পন হয় না। টানেল গেছে নদীর তলদেশ থেকে আরও ১৮-৩১ মিটার নিচ দিয়ে

সুড়ঙ্গ হঠাৎ ভেঙে যাবে কি না, না ভাঙলে তার কারণ কী?

মাটির নিচে এমনিতে অনেক পাইপ থাকে। চাপের কারণে এগুলো তেমন ফাটতে দেখা যায় না। টানেলও গোলাকার একটি পাইপের মতো। যেখানে মাটির নিচ দিয়ে এত চাপ পড়বে না। আবার টানেলের গোলাকার অংশে সেগমেন্ট বসানোর পর কংক্রিট ও লোহা দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে। সুতরাং টানেল ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

টানেলে গাড়ি চলাচলের সময় হঠাৎ ভূমিকম্প হলে কী হবে?

টানেলের নকশা তৈরির সময় ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় টানেলই সবচেয়ে নিরাপদ। ২০ মিটারের নিচের মাটিতে কম্পন হয় না। টানেল গেছে নদীর তলদেশ থেকে আরও ১৮-৩১ মিটার নিচ দিয়ে।

টানেলের ভেতরে কোনো দুর্ঘটনা সিসিটিভি ক্যামেরার সাহায্যে ঘটনাস্থল শনাক্ত হবে। এরপর কুইক রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে গাড়িটি উদ্ধার করবে

কর্ণফুলী নদীতে বড় বড় জাহাজ চলে, এ কারণে কী টানেলে চাপ সৃষ্টি হবে?

না। নদীর ওপরে যত বড় জাহাজই চলুক সেটির কোনো চাপ টানেলে পড়বে না। কারণ, টানেল কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে আরও অনেক নিচে অবস্থিত।

টানেলের ভেতরে দুর্ঘটনা হলে কী হবে?

টানেলের ভেতরে কোনো দুর্ঘটনা সিসিটিভি ক্যামেরার সাহায্যে ঘটনাস্থল শনাক্ত হবে। এরপর কুইক রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে গাড়িটি উদ্ধার করবে।

টানেলের ভেতরে প্রতিটি টিউবের ওপরে একটি বিশেষ হিট সেন্সর তার রয়েছে। কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অতিরিক্ত তাপ তৈরি হবে, সঙ্গে সঙ্গে হিট সেন্সর দুর্ঘটনার স্থান শনাক্ত করবে। একই সঙ্গে অটোমেটিক টানেলে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা সেদিকে ঘুরে যাবে। এরপর মনিটরিং স্থান থেকে দ্রুত টানেলের ব্যবস্থাপনায় থাকা চীনা কর্তৃপক্ষের রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে। তারা সেখানে গিয়ে আগুন নির্বাপণ করবে

টানেলের ভেতরে আগুন লাগলে কী হবে?

টানেলের যে লেনে অগ্নিকাণ্ড হবে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। টানেলে প্রবেশের শুরুতে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে নির্দেশনা আসবে। টানেলের ভেতরে প্রতিটি টিউবের ওপরে একটি বিশেষ হিট সেন্সর তার রয়েছে। কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অতিরিক্ত তাপ তৈরি হবে, সঙ্গে সঙ্গে হিট সেন্সর দুর্ঘটনার স্থান শনাক্ত করবে। একই সঙ্গে অটোমেটিক টানেলে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা সেদিকে ঘুরে যাবে। এরপর মনিটরিং স্থান থেকে দ্রুত টানেলের ব্যবস্থাপনায় থাকা চীনা কর্তৃপক্ষের রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে। তারা সেখানে গিয়ে আগুন নির্বাপণ করবে।

অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে টানেলের দুই টিউবের দুই প্রান্তের চারটি ফ্লাড গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া, বৃষ্টি বা নানা কারণে প্রবেশমুখ দিয়ে টানেলে পানি ঢুকলে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হবে। টানেলে প্রতিটি টিউবের মাঝখানে গভীরতম স্থানে পাম্প স্টেশন বসানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে পানি জমবে। এরপর টিউবের নিচের অংশে থাকা চ্যানেল দিয়ে এসব পানি আনোয়ারা অংশে ফেলে দেওয়া হবে

এ ছাড়া, বড় অগ্নিকাণ্ড হলে দুপাশে গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ সময় ভেতরে থাকা লোকজন ক্রস প্যাসেজ দিয়ে আরেকটি টিউবে চলে যেতে পারবেন। ৬৫০ মিটার পরপর এমন ক্রস প্যাসেজ রয়েছে। এ ছাড়া, টানেলের সড়কে ৮০ মিটার পরপর নিচে নামার চ্যানেল রয়েছে। কেউ এই পথে নিচে নেমে চ্যানেল দিয়ে টানেলের যেকোনো প্রান্তে নিরাপদে পৌঁছাতে পারবেন। 

টানেলে পানি ঢুকে গেলে?

প্রথমত, অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে টানেলের দুই টিউবের দুই প্রান্তের চারটি ফ্লাড গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া, বৃষ্টি বা নানা কারণে প্রবেশমুখ দিয়ে টানেলে পানি ঢুকলে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হবে। টানেলে প্রতিটি টিউবের মাঝখানে গভীরতম স্থানে পাম্প স্টেশন বসানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে পানি জমবে। এরপর টিউবের নিচের অংশে থাকা চ্যানেল দিয়ে এসব পানি আনোয়ারা অংশে ফেলে দেওয়া হবে।

জানা গেছে, চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পকারখানা।

নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেই হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

এমআর/এমএআর/