শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আট মাসে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকসহ পাঁচজনকে হত্যা করে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা। ইসলামবিরোধী লেখা ও কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে তাদের হত্যা করা হয়।

ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের লেখক অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যা করে উগ্রপন্থীরা। একই বছরের ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস, ৭ আগস্ট ব্লগার নিলাদ্রী চ্যাটার্জি (নিলয় নীল) এবং ৩১ অক্টোবর ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করায় জাগ্রত প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়।

দীপনকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগেই ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল, তার বন্ধু ব্লগার রন দিপম বসু ওরফে সন্দীপ ও তারেক রহিমকে হত্যার উদ্দেশ্য হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ ২ নভেম্বর ভিকটিম রশীদ চৌধুরী টুটুল বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

চাপাতি দিয়ে টুটুলকে তিনটি কোপ দেন সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব

দীর্ঘ তদন্ত শেষে (৫ বছর পর) গত বছরের ৪ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শাহ মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান ইলিয়াস (রমনা জোনাল টিম) ১০ জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। পুলিশ ও আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। চার্জশিটে ২১টি আলামত জব্দ ও ১১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

শাহ মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘গত বছরের ৪ অক্টোবর শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলায় ১০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছি। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে টুটুলসহ তার আরও দুই বন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর আঘাত করেন। তদন্তে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তাই অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য-উপাত্ত পাওয়ায় তাদেরকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছি। চার্জশিটে ২১টি আলামত জব্দ ও ১১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

মামলার বাদী বা আরও দুই ভিকটিম চার্জশিটের বিষয়ে জানেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘আগেও মামলাটি নিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তদন্ত করেছেন। আমি তদন্তভার গ্রহণ করে ভিকটিমদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে তারা জানেন কি না, তা আমার জানা নেই।’

টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম হোতা আবদুস সবুর

মামলার বাদী আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ঘটনার সময় উপস্থিত ভিকটিম এবং মামলার চার্জশিটের সাক্ষী রাসেল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি শুদ্ধস্বর প্রকাশনী অফিসের দারোয়ান হিসেবে কাজ করতাম। ঘটনার দিন আমাকে অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করে রাখে আসামিরা। এছাড়া ঘটনার কিছুদিন পর শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক টুটুল দেশের বাহিরে চলে যান বলে শুনেছি। এ বিষয়ে আর কিছু জানি না।’

ঘটনার দিন কী হয়েছিল— এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসেল বলেন, ‘পাঁচ বছর আগের ঘটনা, কী হয়েছিল সঠিক মনে নেই। তবে এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।’ একই কথা বলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও চার্জশিটভুক্ত সাক্ষী ওয়াকিফুল হক শক্তি।

তিনি বলেন, ‘তখন আমি চাকরি করতাম বিডি নিউজের প্রকাশনা সাইডে। প্রকাশনার বিষয়ে বিভিন্ন প্রকাশকের অফিসে কাজের জন্য যাওয়া লাগত। ঘটনার দিন আমি শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিসে গিয়ে ওই ঘটনা দেখি। তবে এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। ঘটনার প্রথম এক বছর ডিবি অফিস ও পুলিশ আমার কাছ থেকে জবানবন্দি নিয়েছে। এখন আমার কিছু মনে নেই, কী বললে কী হয়? আর কিছু বলতে চাই না।’

মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব, হাফেজ মো. আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ, মইনুল হাসান শামীম, রশিদ-উন নবী ভূঁইয়া, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন, আরাফাত রহমান, দুলাল ক্যাসেল, শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জোবায়ের, মোর্তুজা ফয়সাল সাব্বির ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। চার্জশিটে শেষের দুজন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিরা কারাগারে আছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন, আসামিরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তাদের দলনেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউর হক। তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন ব্লগার ও ইসলামবিরোধীদের হত্যা করা। জিয়ার নির্দেশে তারা এসব কাজ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় আসামিরা পরিকল্পিতভাবে পরস্পর সহযোগিতায় ঘটনাটি সংঘটিত করেন। যা দণ্ডবিধি ৬৪৮, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭ ও ৩৪ ধারায় অপরাধ।

৬টি খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক 

আদালতে মোহাম্মদপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক মনির আহমেদ মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার চার্জশিটভুক্ত দুজন আসামি মোর্তুজা ফয়সাল সাব্বির ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক পলাতক রয়েছেন। তাদের সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় জন্য গত ৪ এপ্রিল দিন ধার্য ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ। আদালতের কার্যক্রম চালু হলে সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া জন্য ফের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।

মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব, হাফেজ মো. আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ, মইনুল হাসান শামীম, রশিদ-উন নবী ভূঁইয়া, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন, আরাফাত রহমান, দুলাল ক্যাসেল, শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জোবায়ের, মোর্তুজা ফয়সাল সাব্বির ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। চার্জশিটে শেষের দুজন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিরা কারাগারে আছেন

টুটুল, ব্লগার সন্দীপ ও তারেক রহিমকে হত্যার পরিকল্পনা যেভাবে করা হয়

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন, আসামি সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিবের দেওয়া জবানবন্দিতে তাদের হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে।

সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব বলেন, হাদী নামের ব্যক্তি একটি ছবি দেখিয়ে বলেন যে টুটুল নামের লোকটি ইসলামের বিরুদ্ধে বই প্রকাশ করেছে, একে মারতে হবে। এজন্যই আপনাদের এখানে আনা হয়েছে। এ সময় ঠিকানা সুমনকে দেওয়া হয়। ঠিকানাটি মোহাম্মদপুর লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর অফিসের। আসামি সুমন, তাহসিন, বাবর, ইয়াহিয়া ও সাব্বির হত্যার পরিকল্পনা করতে তিন-চারদিন লালমাটিয়া যান। সেখানে গিয়ে তারা শুদ্ধস্বরের অফিস ও বাসা দেখে আসেন। গত ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর (ঘটনার দিন) সকালে দলটি বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে লালমাটিয়া যান। এ সময় সুমন, তাহসিন, বাবর ও ইয়াহিয়ার ব্যাগে ছিল চাপাতি। সাব্বিরের ব্যাগে ছিল পিস্তল। সেখানে গিয়ে শুদ্ধস্বর অফিসের সামনে ও আশপাশে তারা অবস্থান নেন।

ঘটনার দিন (৩১ অক্টোবর) টুটুল দুপুর ১২টার পর অফিসে প্রবেশ করেন। আসামি সাব্বির কিছুক্ষণ পর শুদ্ধস্বরের অফিসের দিকে যান। এরপর আনুমানিক ২টা ৪৫ মিনিটে সুমন, তাহসিন, বাবর, ইয়াহিয়া ও সাব্বির টুটুলের অফিসে ঢুকেন। সাব্বির প্রথমে দারোয়ানকে পিস্তল ঠেকান। তাহসিন ও বাবর অফিসে ঢুকেই চাপাতি দিয়ে অফিসের ভেতরের লোকজনকে আঘাত করতে থাকেন। সুমন চাপাতি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ান। পরে সাব্বির এসে পিস্তল দিয়ে একজনকে গুলি করেন। সুমন চাপাতি দিয়ে টুটুলকে তিনটি আঘাত করেন। আঘাতগুলো তার হাতে লাগে। দারোয়ান ছাড়া রুমের ভেতর মোট তিনজনকে আঘাত করে তারা পালিয়ে যান।

মামলার অভিযোগে বাদী আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল যা বলেন

শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বিভিন্ন লেখকের বই প্রকাশ হয়। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর লেখক তারেক রহিম ও ব্লগার বন্ধু রন দিপম বসু ওরফে সন্দীপ বই প্রকাশের জন্য টুটুলের অফিসে আসেন। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে ক্রেতার পরিচয় দিয়ে অফিসে তিনজন দুষ্কৃতকারী আসেন।

শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল

তাদের মধ্যে একজন অফিস স্টাফ রাসেলকে পিস্তল ঠেকিয়ে জিম্মি করে রাখেন। অপর দুজন আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে মাথায়, কপালে ও হাতে গুরুতর আঘাত করেন। রহিমকে চাপাতি দিয়ে মাথায় ও দুই হাতে আঘাত করা হয়। ব্লগার রন দিপম বসু ওরফে সন্দীপকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাতে ও পায়ে গুরুতর আঘাত করে হামলাকারীরা। এরপর মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ সংবাদ পেয়ে আমাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। ওই ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।

টিএইচ/এমএইচএস/ওএফ/এমএআর/