রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মোখার পর হামুন ‘ধাক্কা’
পাইলট প্রকল্পের আওতার প্রথম ধাপে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। রাজি আছে মিয়ানমারও। সেই লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইসহ তাদের মনোবল বাড়াতে বা কাউন্সেলিং করতে দুই দিনের সফরে বুধবার (২৫ অক্টোবর) কক্সবাজার আসার কথা ছিল মিয়ানমারের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের। এর মধ্যেই হঠাৎ প্রকৃতির বৈরী আচরণ তথা ঘূর্ণিঝড় হামুন সামনে এলো। আর স্থগিত হলো মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সফর। ধাক্কা খেল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।
ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত মাসের শুরুতে নেপিডোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মহাপরিচালক পর্যায়ে হওয়া বৈঠকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুতে প্রায় তিন হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে রাজি হয় মিয়ানমার। পরে যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের নিতেও রাজি হয় নেপিডো। যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যে মিয়ানমার থেকে একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার এসে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই এবং কাউন্সেলিং করার সিদ্ধান্ত হয়। সম্প্রতি প্রতিনিধিদলের সফরের দিনক্ষণ ঠিক হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় হামুনের কারণে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সফর স্থগিত করা হয়।
বিজ্ঞাপন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আজ (বুধবার) মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলের আসার কথা ছিল। তাদের ২০ সদস্যের একটি টিম আসার জন্য প্রস্তুতি চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। এর আগে ঘূর্ণিঝড় মোখায় একবার প্রতিনিধিদলের সফর ভেস্তে গেল। আর এবার হামুনে ভেস্তে গেল তাদের সফর। এবার তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল– যারা ভেরিফায়েড না তাদের ভেরিফায়েড করবে এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করবে। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্রিফিংটা করার কথা ছিল।
কবে নাগাদ এ প্রতিনিধিদলের সফর হতে পারে– জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, যে প্রতিনিধিদলের আসার কথা ছিল তারা এখন মিয়ানমারের সিটুয়েতে অবস্থান করছে। তারা চলে যাবে ইয়াঙ্গুনে। তাদের আবার চারদিনের একটা ছুটি আছে, ধর্মীয় কোনো বড় অনুষ্ঠান আছে। মোটামুটি তাদের দিক থেকে পাঁচদিনের গ্যাপ, তারপর আবার আমাদের এখানে উইকেন্ড। এখানে মোটামুটি সাতদিনের গ্যাপ। সাতদিন পরে আলোচনা করতে হবে। আবার নতুন করে তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।
আরও পড়ুন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুর ধাপে দুই হাজার আটশ’র বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ঠিক করা হয়েছে। এ সংখ্যার সঙ্গে তাদের কিছু পরিবার যুক্ত করে প্রায় তিন হাজারের কিছুটা বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গাকে প্রথমে প্রত্যাবাসন করতে চায় বাংলাদেশ। যদি প্রথম ধাপে সফলতা আসে যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরবর্তী ধাপে প্রত্যাবাসন করার লক্ষ্য বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রথম ধাপে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অনুকূল পরিবেশ এখনো হয়নি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পশ্চিমারা তো সবসময় একই কথা বলে আসছে। পশ্চিমারা যা কিছু বলুক, যদি স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা যায় তাদের কিছু বলার থাকবে না। আমাদের দিক থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার। তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ সফরে তিনি এবারই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। সে সময় কক্সবাজারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আফরিন বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো প্রতিকূল পরিবেশ এখনো মিয়ানমারে নেই।
চীনের ভূমিকা নিয়ে এ কর্মকর্তা জানান, চীনের কাজ আমাদের সঙ্গে কম। ওদের ভূমিকা মিয়ানমারে বেশি। ওরা ওখানে কাজ করছে। যারা যাবে তাদের প্রস্তুত করা হলো আসল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন
চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
পরবর্তী সময়ে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। ফলে সাত বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চলতি বছর নতুন করে আবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বেশ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে চীন। তারই অংশ হিসেবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কুনমিংয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে বৈঠক করেছে চীন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রোহিঙ্গাদের একটি দল নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাখাইন সফর করবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন সফর করেন। ফিরতি সফরে রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে সেটি পিছিয়ে দেয় মিয়ানমার। পরবর্তীতে গত ২৫ মে ১৪ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ঘুরে যায়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়া প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।
এনআই/এসএসএইচ