‘আমি ভেবেছিলাম আমি শেষ। মনে হচ্ছিল এই অবস্থা থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব না। কিন্তু কীভাবে যে এখনো বেঁচে আছি, বুঝতে পারছি না। আল্লাহ যে কীভাবে বাঁচিয়ে এনেছে আমি কিছুই বলতে পারছি না।’ 

মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) ঢাকা পোস্টের কাছে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা বেঁচে যাওয়া মো. আবুল কাশেম। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। 

দুর্ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আবুল কাশেম বলেন বলেন, ‘পাশের আরেকটি ট্রেন আমাদের ট্রেনে পরপর তিনটি ধাক্কা দেয়। তখন একপর্যায়ে আমাদের ট্রেনের বগি হেলে পড়ে যায়। তখন কেউ বগির নিচে চাপা পড়ে, কেউ সিটের নিচে চাপা পড়ে। সবাই শুধু চিৎকার করছিল বাঁচাও বাঁচাও করে। কিন্তু কেউই উঠতে পারছিল না। আমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত আছে কি না, সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে আমিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনার ১০ মিনিট পর্যন্ত আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। হঠাৎ করে শুনি ট্রেনের মাস্টার চিল্লাচিল্লি করছে বাঁচাও বাঁচাও করে। তখনই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন কোনোরকমে নিজের পা সিটের ভেতর থেকে টেনে বের করেছি। তারপর আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হাসপাতালে যাওয়ার পর আমার চোখ খোলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনা হঠাৎ করেই হয়েছে, আমরা বুঝতেও পারলাম না। ট্রেনের ভেতরে কেউ দাঁড়িয়েছিল, আবার কেউ বসেছিল। হঠাৎ করেই যখন ধাক্কা লাগে, একজন আরেকজনের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ে যায়। এই অবস্থায় বের হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কারো হাত-পা ভেঙেছে, কেউ সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে।’

‘সারাজীবনের জন্য অচল হয়ে গেলাম, ঘরে বিয়ের উপযুক্ত তিনটি মেয়ে, তাদের বিয়ে কীভাবে দেব? তারা পড়াশোনা করে, সেই খরচ কীভাবে চালাব? নিজেই বা কীভাবে চলবো, কী খাব? নিজে কষ্ট করেছি, কিন্তু আমার সন্তানদের কোনো কষ্ট করতে দেইনি। এখন নিজের চোখে আমার সন্তানদের না খেয়ে থাকতে দেখতে হবে, তাদের কষ্ট দেখতে হবে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই মনে হয় ভালো ছিল।’

‘নিজে কিছু কাজ করতাম, মাথায় জিনিসপত্র বইতে পারতাম, এখন তো একটা হাত আর পা অচল হয়ে গেল, কীভাবে আয়-রোজগার করব? একদিন কাজ না করলে যেখানে ঘরে রান্না হয় না, সেখানে এই পঙ্গু মানুষটা কীভাবে কী করবে?’

সহায়তার আকুতি জানিয়ে আবুল কাশেম বলেন, ‘সরকারের কাছে অনুরোধ, দয়া করে আমার জন্য কিছু করুন। এই দুর্ঘটনায় আমার মতো যারা পঙ্গু হয়েছে, তাদের জন্য কিছু করুন। অন্তত যদি আমরা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারি, তাহলেই হবে, আমরা বেশি কিছু চাই না।’

এর আগে, সোমবার (২৩ অক্টোবর) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ভৈরব জংশনের কাছাকাছি জগন্নাথপুর এলাকায় কিশোরগঞ্জ এগারসিন্দুর গোধূলি ও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসা মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৭ জন নিহত হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভৈরবে যাত্রীবাহী ট্রেনে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় আহত ২২ জন মুমূর্ষু রোগীকে উন্নত চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানসহ (নিটোর) রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালে ১৬টি মরদেহ সংরক্ষিত আছে, যাদেরকে কোনো ধরনের ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আরও অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন।

টিআই/কেএ