আশ্বিন মাসের শেষে এসেও এবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। টানা বৃষ্টিপাতের ফলে রাজধানীতে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে কয়েকদিন পরপর ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। মেগা এই সিটির বাসিন্দাদের প্রশ্ন— সারা বছর দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে খানাখন্দ, সিটি করপোরেশন নাকি নানা কাজ করছে, তারপরও বর্ষায় এই জলাবদ্ধতা কেন?

কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি ও প্রধান প্রধান সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। বৃষ্টি একটু দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলে রীতিমতো ‘ডুবে যায়’ ঢাকা শহর। হাঁটু ও বুক সমান পানিতে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু প্রকল্প ও পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ফলাফল যেন শূন্যই থেকে যাচ্ছে। কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না।

গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। ডুবে গিয়েছিল প্রায় সব সড়ক। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জলাবদ্ধতা ছিল বহু সড়ক ও অলিগলিতে। এখনো যেকোনো দিন বৃষ্টি হলে থই থই পানি জমছে সড়কে। কিছু এলাকায় বৃষ্টির পর চলাচলের কোনো উপায় থাকে না।

রাজধানীর মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর ১৩, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তায, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে নিয়মিত।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু এলাকায় পানি নেমে গেলেও নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি, আজিমপুর, নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ এলাকা, বংশালসহ আরও কিছু এলাকায় পানি জমে থাকে দীর্ঘ সময়।

প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হতে বাধ্য হওয়া নগরবাসী জলাবদ্ধতা নিয়ে চরম বিরক্ত। তারা বলছেন, বছরজুড়ে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে বেড়ায়। তাহলে এত কাজ, এত উদ্যোগ— এত কিছুর পরও কেন বারবার ডুবছে ঢাকা?

নিউ মার্কেটের বাইরে অস্থায়ী দোকানি রুহুল আমিন বলেন, ইদানীং বৃষ্টি হলে খুব ভয় লাগে। কারণ বৃষ্টি হলেই দুই তিনদিন পর্যন্ত জলাবদ্ধতা থাকে। ফলে আমাদের ব্যবসাও বন্ধ থাকে। দোকান খুলতে পারি না, পানির কারণে কাস্টমার আসতে পারে না। আগে বৃষ্টির পর কিছু সময় পানি থাকত, পরে নেমে যেত। কিন্তু এখন দুই-তিন দিন ধরে থাকে।

রাজধানীর বকশিবাজার এলাকার বাসিন্দা হাজি মকিদুর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে যে তীব্র বৃষ্টি হলো সেসময় আমার এলাকার অনেক বাড়ি থেকে দুইদিন কেউ বেরই হতে পারেনি। খুব প্রয়োজনে যারা বের হয়েছে তারা হাঁটু পানি মাড়িয়ে এখানে ওখানে গেছে।

পুরো এলাকা জলাবদ্ধ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সারাজীবন জলাবদ্ধতার মধ্যে চলাফেরা করতে হয়। আগেও জলাবদ্ধতা ছিল, এখনও জলাবদ্ধতা আছে। তবে এখন পানি জমে থাকার সময়সীমা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সবাই মিলে স্থানীয় কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে এর সমাধান চেয়েছি। সেখান থেকে আমাদের জানানো হয়েছে- কামরাঙ্গীরচর হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি চলে যাওয়ার পথ অনেকাংশেই বন্ধ রয়েছে, এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তুপের কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ওইদিকে বংশাল এলাকায় আমার বোনের বাসা, সেই এলাকায়ও জলাবদ্ধতা ইদানীং ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বৃষ্টি হলেই দুই-তিন দিন টানা হাঁটু পানি জমে থাকছে।

রাজধানীর ধানমন্ডি-২৭ এলাকার দোকানি খোরশেদ আলম পলাশ বলেন, আমাদের এই এলাকায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। হালকা কিংবা ভারী যে বৃষ্টিই হোক রাজধানীর আর কোথাও জলাবদ্ধতা না হলেও এই ধানমন্ডি-২৭ এলাকায় হবে। তবে একটা দিক ভালো, জলাবদ্ধতা হলেও কয়েক ঘণ্টা পর পানি নেমে যায়।  

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের স্থায়ী কিছু একটা করা দরকার। কারণ জলাবদ্ধতা হলে আমাদের এলাকায় যানচলাচল, মানুষের যাতায়াত এবং ব্যবসায় খারাপ প্রভাব পড়ে। আমরা এই সমস্যা থেকে স্থায়ী মুক্তি চাই।

জলাবদ্ধতার কারণ কী, বৃষ্টির পানি কেন সরে যেতে পারে না? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার পানি তিনটি মাধ্যমে আশপাশের নদ-নদীতে গিয়ে পড়ে। পাম্প স্টেশন, স্লুইসগেট ও খাল। বর্তমানে বেশ কয়েকটি পাম্প স্টেশন অকেজো হয়ে আছে। একইভাবে স্লুইসগেটগুলোও অকেজো অবস্থায় আছে। আর খালগুলোর অবস্থা ভালো নয়, সেগুলো পানি প্রবাহের উপযুক্ত নয়। অবৈধ দখলের পাশাপাশি নানা বর্জ্য জমে জমে খালগুলোতে কয়েক স্তরের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে আছে।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশই প্লাস্টিক বর্জ্য, যা ঢাকার ড্রেন, নালা আর খালে গিয়ে পড়ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খালে বা ড্রেনে আটকে থাকছে, যে কারণে পানি নামতে পারছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলে তেমন জলাবদ্ধতা হচ্ছে না, তবে টানা বৃষ্টি হলে পানি নামতে সময় লাগছে। এর মূল কারণ আমাদের সবার অসচেতনতা। আমরা বোতল ও অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য ফেলে দিচ্ছি রাস্তায় ও ড্রেনে। সেগুলো গিয়ে পানির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা ১০টি কুইক রেসপন্স টিম গঠন করে দিয়েছি। তারা এ নিয়ে কাজ করছে।

মেয়র অভিযোগ করে বলেন, কল্যাণপুরে ১৩০ একর জায়গায় ওয়াটার রিটেনশন পাম্প ছিল, যেখানে বৃষ্টির পানি গিয়ে জমা হতো। সেখানে একটি সরকারি সংস্থা ৪০ বিঘা জমি বালি দিয়ে ভরাট করেছে। তাহলে রাজধানীর পানিগুলো কোথায় গিয়ে নামবে?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া বেশ কয়েকটি স্লুইসগেট পুরোপুরি সক্ষমতা অনুযায়ী কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনে আমরা চেষ্টা করলেও বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এজন্য পুরোনো আউটলেটগুলো আরও কার্যকর করার পাশাপাশি নতুন করে আউটলেটের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।

একসময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। তখন ওয়াসা ও সিটি কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করত। পরে রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশন মিলে গত ১২ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

দায়িত্ব ছাড়ার আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এ প্রকল্প থেকে রাজধানীবাসী কোনো সুফল পাননি। দ্বিতীয় ধাপে ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে গত ১০ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যয় করেছে প্রায় দুই হাজার ২৫ কোটি টাকা।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরের আড়াই বছরে অর্থাৎ গত অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। এভাবে নানা সময় ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে কিন্তু নগরবাসী কোনো সুফল পাননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরের দিনেও জলাবদ্ধতার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ড্রেন ঠিকমতো পরিষ্কার না থাকা, প্লাস্টিক, পলি বর্জ্য, ককশিট জাতীয় পরিত্যক্ত পণ্য ড্রেন ও অন্যান্য জায়গায় আটকে থাকা। এছাড়া কামরাঙ্গীরচর হয়ে বেড়িবাধ দিয়ে পানি চলে যাওয়ার পথ অনেকাংশেই বন্ধ। সব মিলিয়ে নিউমার্কেট, বংশাল ও আশেপাশের এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে,  ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএসসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্লাস্টিক, পলিথিন পণ্য ও অপচনশীল বর্জ্যকে আলাদা করে ফেলার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া কাজে আসলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির অন্যান্য এলাকায়ও এই পদ্ধতিতে কাজ করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১২৫০ কিলোমিটার ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করার পাশাপাশি পানিপ্রবাহ নিশ্চিতে কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি খাল থেকে গত এক বছরে প্রায় দুই লাখ টন বর্জ্য অপসরণ করেছে। অন্যদিকে, কল্যাণপুর রিটেনশন পাম্প এলাকাকে একটি অত্যাধুনিক হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে বেদখল হওয়া ৫৩ একর জায়গা উদ্ধারের পর এখন খনন কাজ চলছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তা আরও দীর্ঘ পরিকল্পনামাফিক করতে হবে। তা না হলে রাজধানীবাসী জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে না। পাশাপাশি জলাধার সংরক্ষণ ও ড্রেন, নালা, খাল নিয়মিত পরিষ্কার রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। কোন কোন পথ দিয়ে শহরের পানি নামবে তা আগে যে কোনো মূল্যে ক্লিয়ার রাখতে হবে।

দুই সিটি কর্পোরেশনকে শুধু স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা নয় বরং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে তা যথাযথ বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এএসএস/এমজে