পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ‘ডাবল বেনিফিটে’র দিন আজ
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন হচ্ছে আজ। ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতু উপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে এই রেলপথে বেশ কয়েকবার পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল করেছে। মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) উদ্বোধন হওয়ার সপ্তাহখানেক পর এই পথে বাণিজ্যিক ট্রেন চালাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আর এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ পদ্মা সেতুর ডাবল বেনিফিট ভোগ করতে পারবেন।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক পথে যান চলাচল শুরু হয়েছে আরও বছর খানেক আগে। তবে দোতলা বিশিষ্ট এই পদ্মা সেতুর নিচতলা দিয়ে ট্রেন চলাচলের অপেক্ষায় ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ। সেই স্বপ্নই আজ পূরণ হতে চলেছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত চলমান থাকলেও আজ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে চালু করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে মাওয়া রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হবেন। সেখানে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এবং নাম ফলক উন্মুক্ত করবেন। পরে ১২টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাবেন।
এ প্রসঙ্গে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ বলেছেন, মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত ট্রায়াল ট্রেন চালানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে করে মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত যাবেন। আশা করি ঠিক সময়ে যেতে পারবেন।
রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রকল্পের যে মূল কাজ ছিল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল, সেটি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা আপাতত নতুন কোনো ট্রেন নিয়ে ভাবছি না। তবে খুলনা থেকে যেসব ট্রেন ঢাকায় চলাচল করে তার মধ্যে একটি কিংবা দুটি ট্রেন এ পথে ডাইভার্ট করা হবে।
যত হতে পারে ভাড়া
এদিকে পদ্মা সেতু দিয়ে যেসব ট্রেন চালানো হবে, সেসব ট্রেনের ভাড়া প্রস্তাব করেছে রেলওয়ের কমিটি। প্রস্তাবনা অনুসারে, পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার, গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের প্রতি কিলোমিটারকে ৫ কিলোমিটার ধরা হয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে ভাঙ্গার প্রকৃত দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার হলেও রেলওয়ে দেখিয়েছে ৩৫৩ কিলোমিটার দূরত্ব। ফলে আনুপাতিক হারে বেড়ে গেছে ওই পথের ভাড়াও।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেনে শোভন চেয়ারের প্রস্তাবিত ভাড়া ৩৫০ টাকা, এসি চেয়ারের ভাড়া ৬৩৩ টাকা এবং এসি সিটের ভাড়া ৭৫৯ টাকা হতে পারে।
রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবটি বর্তমানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রস্তাবিত ভাড়াই অনুমোদিত হতে পারে।
পদ্মা সেতুতে ট্রেন, উচ্ছ্বসিত জনসাধারণ
ঢাকা-ভাঙা রেলপথ উদ্বোধনের খবরে এলাকাবাসীর মনে উচ্ছ্বাসের জোয়ার বইছে। তাদের অনেকে বলছেন, এবার বুঝি ট্রেনে চড়ার সাধ মিটবে।
কখনও ট্রেনে চড়েননি শিবচরের বাসিন্দা মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকার উপর দিয়ে কখনও ট্রেন চলবে সেটা ভাবিনি। ট্রেন চলাচলের খবর শুনে আমি অনেক খুশি। কখনও ট্রেনে চড়িনি, এবার সেই সাধ পূরণ হবে। আগে শিবচর থেকে ঢাকা যেতে ফেরি পার হতে হতো। এরপর গত বছর চালু হলো পদ্মা সেতু। চালু হওয়ার পর এখন রাত-দিন যেকোনো সময় ঢাকায় যাওয়া-আসা করা যায়। তবুও ঢাকায় ঢুকতে যানজটে পড়তে হয়। এখন যদি ট্রেন চালু হয় তাহলে ঢাকায় যেতে আর যানজটের চিন্তা করতে হবে না। এই ট্রেন যোগাযোগ আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছে।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত ভাড়া বেশি মনে হয়েছে। এর চেয়ে সড়ক পথেই ভাড়া কম। সময়ও আগের চেয়ে কম লাগছে।
ফরিদপুরের নগরকান্দার বাসিন্দা আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেন চলাচলের খবরে আমাদের ভালো লাগছে। এখন আমাদের এখানে নতুন রেলপথ হয়েছে, নতুন ট্রেন দিচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলবে এটা ভাবতেই আমাদের ভালো লাগছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বাসে এখন আমাদের ঢাকায় যেতে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আগে দুই ঘণ্টা সময় লাগত শুধু ফেরি পার হতে এবং ঢাকায় যেতে লাগত প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা।
তিনি বলেন, ভাঙ্গা থেকে ঢাকায় যেতে লোকাল বাসগুলো প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া নেয়। ক্ষেত্র বিশেষে সাড়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নেয়। ঈদের সময় প্রায় ৪০০-৫০০ টাকা ভাড়া নেয়। এখন ট্রেন চলাচল শুরু হলে সরকার নির্ধারিত ভাড়া থাকবে। অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়ার কোনো জটিলতা থাকবে না। আমি মনে করি, বাস থেকে ট্রেনের জার্নি সবচেয়ে আরামদায়ক হবে। তবে ট্রেনের ভাড়া বেশি মনে হয়েছে।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ২টি লোকমোটিভসহ ১০টি কোচের পরীক্ষামূলক ট্রেন একটি লম্বা হুইসেল দিয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ছাড়ে। আর এর মধ্যে দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা যুক্ত হয় রেলপথে।
পরীক্ষামূলক যাত্রার প্রথম ট্রেনটির লোকোমাস্টার হিসেবে এনামুল হক এবং সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে এম এ হোসেন ট্রেন চালিয়েছিলেন। আর গার্ড হিসেবে ট্রেন পরিচালনা করেন আনোয়ার হোসেন।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু পুরো এই পথটি এখনও নির্মাণ না হওয়ায় আপাতত ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করছে সরকার। গত বছর পদ্মা সেতু যখন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন থেকে রেলওয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয় মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজে। এরপরও পুরো ঢাকা-যশোর অংশের কাজ শেষ করতে না পারায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ। পরে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, শুরুতে ৩টি স্টেশনের (মাওয়া, পদ্মা (জাজিরা) ও শিবচর) সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হবে। এর বাইরে নিমতলা স্টেশনটিও চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে উদ্বোধনের এক সপ্তাহ পরে। শুরুতে একটি ট্রেন নিয়মিত পরিচালনা করা হবে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে ঢাকা-পদ্মা সেতু-রাজবাড়ী রুটে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাঙ্গা পর্যন্ত আসে। এ ট্রেনটি ঢাকা পর্যন্ত আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, উদ্বোধনের তিন মাসের মধ্যে প্রধান প্রধান স্টেশনগুলো চালু হয়ে যাবে। ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পাঠানো হয়েছে। তবে মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
স্বল্পমেয়াদি ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে। একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন ৭ জোড়া ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন চলবে ৫ জোড়া ট্রেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে এ প্রাক্কলনটি তৈরি করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ২০১৬ সালে অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার মূল রেলপথের বাইরে ৪৩ কিলোমিটার লুপ লাইন (স্টেশনের আগে-পরে বাড়তি লাইন) নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১০০ আধুনিক যাত্রীবাহী বগিও কেনা হয়েছে। এগুলো দিয়ে রেক সাজিয়ে নতুন ট্রেন চালু করা হবে। বর্তমানে পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা-যশোর রুটে ট্রেন চালানোর টার্গেট রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে তৈরি নতুন ব্রডগেজ রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে। এ পথে থাকবে না কোনো রেলক্রসিং। কারণ, যেখানেই রেললাইন ও সড়ক মিলেছে, সেখানেই পাতালপথ তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ২০টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ১৪টি নতুন এবং ৬টি আগে থেকেই রয়েছে। আগের স্টেশনগুলোরও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি যখন ২০১৬ সালে অনুমোদন করা হয়, তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই রেলপথ জিটুজির (সরকারের সঙ্গে সরকারের) ভিত্তিতে চীনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করছে সিআরইসি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
এমএইচএন/এসকেডি