রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ‘প্রভাবিত’ করতে বাড়ছে গুজব
জাতীয় নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভার্চুয়াল জগতে বাড়ছে গুজবের সংখ্যা। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতেই এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন ফ্যাক্ট চেকার বা তথ্য যাচাইকারীরা।
তারা বলছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক গুজবগুলো ছড়ানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। গুজব রোধে ব্যক্তি সচেতনতা, সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন করা ছাড়াও পাঠ্যপুস্তকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মাবলী যুক্ত করাও প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, চলতি মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৮ দিনে মোট ৪৩টি গুজব শনাক্ত করেছে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। এর মধ্যে ১৮টি গুজবই রাজনৈতিক।
অন্যদিকে, জানুয়ারিতে ১৮০, ফেব্রুয়ারিতে ১১৩, মার্চে ১৪৮, এপ্রিলে ১৫০, মে-তে ১৫৩, জুনে ১১১, জুলাইয়ে ১২৮, আগস্টে ১৫২ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৭৯টি গুজব শনাক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি। যার বড় একটি অংশই ছিল রাজনৈতিক গুজব।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছড়ানো হচ্ছে গুজব
রিউমার স্ক্যানারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মো. ছাকিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করেই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সামনে যেহেতু নির্বাচন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এ গুজবগুলো ছড়ানো হচ্ছে। যখন যেটা সামনে আসছে তখন সেটাকে কেন্দ্র করেই গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যাতে করে প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘কোন একটি বিষয় বা তথ্য হয়ত ভুল কিন্তু তারা এটাকে মিথ্যাভাবে ছড়াচ্ছে। এটা হয়ত তাদের (যারা ছড়ায়) জন্য পজিটিভ কিন্তু এটি ভুল তথ্য। আবার আরেকটি পক্ষ তথ্যটিকে বিকৃত করে ছড়াচ্ছে। এরকমভাবে তারা একটি উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক গুজবগুলো ছড়াচ্ছে। আর যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছে তারা হয়ত বুঝে না বুঝে বা একটা আদর্শ থেকে সেগুলো প্রচার করছে।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘যেমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে যদি আমি ধরি, কোন একটি দলের কেন্দ্রীয় নেতা একটি তথ্য ছড়ালেন বা প্রচার করলেন। কিন্তু সেই তথ্যটা ভুল। তিনি ইচ্ছে করে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সেটি ছড়িয়েছেন। তার যে নেতাকর্মীরা আছে বা তাকে যারা অনুসরণ করে তখন এটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। তারা যাচাই করার প্রয়োজন মনে না করে শেয়ার করছে। তারা মনে করছে, তাদের নেতা যখন দিয়েছেন এটা সত্যিই। এই যে একটা বিষয়, এ প্রবণতাটা বেশি দেখা যায়। এটা দলের ক্ষেত্রে হতে পারে বা কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও হতে পারে।’
মো. ছাকিউজ্জামান বলেন, আমরা প্রতিমাসে গড়ে প্রায় দেড় শতাধিক গুজব শনাক্ত করছি। এর মানে এই নয় যে শুধুমাত্র দেড় শতাধিক গুজবই প্রচার হচ্ছে। এ সংখ্যাটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। একেক মাসে একেক রকম হতে পারে। সেজন্য প্রকৃত সংখ্যাটা বলা মুশকিল। তবে এর পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে। যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসবে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রেক্ষাপটটা আরও বেশি ভয়াবহ হবে এবং এ গুজব ছড়ানোর প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।’
গুজব ছড়ানোতে ‘টপ টু বটম’ সবাই জড়িত
বাংলাদেশভিত্তিক তথ্য যাচাইয়ের আরেক প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্ট ওয়াচের পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গুজব ছড়ানোর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রাজনৈতিক কারণ। এর সঙ্গে ‘টপ টু বটম’ সবাই আছে। অনেক হাইপ্রোফাইল লোকও আছে, আবার ছোট অনেক আমজনতা গুজবও ছড়ান। কেউ জেনে ছড়ান, কেউ না জেনে ছড়ান। কেউ তার সেলিব্রেটি ইমেজ ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেন। এ কারণে তাকে অনুসরণকারীরা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেন এবং তারাও ছড়াতে থাকেন।’
সুমন রহমান বলেন, ‘গুজব ছড়ানোর সংখ্যা অনেক। এর সংখ্যা কখনো বেশি আবার কখনো কম হয়। সামনে যেহেতু নির্বাচন এখন এটি বাড়তির দিকে আছে। যখনই কোন একটি ইভেন্ট ঘটে, যেমন তামিম ইকবালের পদত্যাগ বা তাকে বাদ দেওয়া, এটা নিয়ে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সবখানেই গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ রকম একটা করে যখন ঘটনা ঘটে তখন আমরা দেখি যে প্রাসঙ্গিক কিছু গুজব ভাইরাল হয়।’
নেই সুষ্ঠু তদারকি
রাজনৈতিক গুজবগুলোর বিষয়ে বেসরকারি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গুজব প্রতিরোধ টিম কাজ করলেও তা যথেষ্ট নয়। এ নিয়ে নেই সরকারি কোনো তৎপরতাও। গুজব প্রতিরোধে বিটিআরসি, আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রয়েছে একটি গুজব প্রতিরোধ কমিটি। এছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং তথ্য অধিদপ্তরের দুটি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটি শুধুমাত্র মন্ত্রণালয়ভিত্তিক গুজব নিয়ে কাজ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গুজবের বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এই কমিটি আগে অনেক একটিভ ছিল। রাত ২-৩টায়ও কাজ হতো। এখন হয় না বললেই চলে।’
আরও পড়ুন
অধিদপ্তরের ‘ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি’র একজন সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ভিত্তিক গুজবের বিষয়ে কাজ করি, রাজনৈতিক গুজবের বিষয়ে নয়। আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, আমরা সেভাবে কাজ করি।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গুজব শনাক্তকরণের জন্য অনেক উপকরণ লাগে। আমাদের সে রকম কোনো উপকরণ সরবরাহ করা হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য অফিসার মো. শাহেনুর মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অধিকাংশ গুজব রাজনৈতিকভাবেই ছড়ানো হয়। এক্ষেত্রে তারা (রাজনৈতিক দল) কাজ করে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহ্মুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেল (গুজব প্রতিরোধ সেল) দিয়ে গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। গুজব ছড়ায় এক ঘণ্টায়। তবে সেলের কাজ আছে, পলিসি তৈরি করে তারা।’
গুজব রোধে দরকার ব্যক্তি সচেতনতা, নিতে হবে ব্যবস্থা
রিউমার স্ক্যানারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মো. ছাকিউজ্জামান বলেন, ‘গুজব প্রতিরোধে ব্যক্তি সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নিজেকে আগে সচেতন হতে হবে। আমি যখন সচেতন হব, আমার সামনে যখন কোনো তথ্য আসবে তখন আমি দেখব এবং যাচাই করব। আমরা যদি এটাকে শেয়ার না করে অথবা বিশ্বাস না করে যাচাই করি, সামান্যতম জ্ঞান দিয়ে যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি যাচাই করার চেষ্টা করি, তাহলে গুজবের পরিধি আস্তে-আস্তে কমে আসবে।’
আরও পড়ুন
ছাকিউজ্জামান বলেন, ‘গুজব রোধে সরকার নিজেদের উদ্যোগে কাজ করতে পারে। তারা নিজস্বভাবে ফ্যাক্ট চেকিং করতে পারে। এছাড়াও সচেতনতা কর্মসূচি নিতে পারে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। কারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিশাল একটি গোষ্ঠী তরুণ, তাই তাদের সচেতন করার বিষয়ে কাজ করতে হবে। তারপর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে টার্গেট করে সচেতন করা যায়। পাশাপাশি যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
ফ্যাক্ট ওয়াচের পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গুজব প্রতিরোধে দুটি জায়গায় কাজ করতে হবে। প্রথমত, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। অর্থাৎ আমরা যেটাকে বলি সোশ্যাল মিডিয়া লিটারেসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু দেখলেই সেটা বিশ্বাস না করা। দ্বিতীয়ত, যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হাতের কাছে রাখা।’
দরকার সুনির্দিষ্ট আইন
সুমন রহমান বলেন, ‘গুজবের বিষয়ে কোনো আইন নেই। অন্যান্য আইনের অংশ হিসেবে গুজব যারা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যেমন, আমি আপনার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ালাম আপনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন কিন্তু সেটি মানহানির মামলা। বিষয়টি এ রকম। অর্থাৎ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন নেই। আমার মনে হয় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন করাটা জরুরি।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ানো সরকারের কাজ। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকে সোশ্যাল মিডিয়া লিটারেসি যুক্ত করা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কাজটি সরকারকে করতে হবে। আইন প্রণয়ন করাও সরকারের কাজ। তাই বিভিন্ন পদক্ষেপের বাস্তবায়ন সরকারকেই করতে হবে।’
এসএইচআর/এসকেডি