আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে গোপনীয় মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে নিজেদের সাংগঠনিক যোগাযোগ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিলেন তারা।

দুটি পিস্তল ও ১৫ রাউন্ড গুলিসহ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির নায়েবে আমির ঢাকা অঞ্চলের আস্কারি বিভাগের প্রধানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

শনিবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি টিম।

গ্রেপ্তাররা হলেন, নায়েবে আমির সাখাওয়াতুল কবির ওরফে আনিস ওরফে রফিক (৪৫), ইহছানূর রহমান ওরফে মুরাদ ওরফে সাইফ (২৬), বখতিয়ার রহমান ওরফে নাজমুল (৩০), ইউসুফ আলী সরকার (৩১) ও জাহেদুল ইসলাম ওরফে আশ্রাফ (৩৫)।

জেলে থেকেও সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন নায়েবে আমীর সাখাওয়াতুল কবির ওরফে আনিস। ২০১৮ সালের পর জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে অস্ত্র কিনতে অর্থ সহায়তা ও এর প্রধান শামীন মাহফুজকে মাসিক ভাতা দিয়েছে আনসার আল ইসলাম।

রোববার (৮ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে আনসার আল ইসলামের এই গ্রুপটির ওপর নজর রাখছিলাম। ধারাবাহিক গোয়েন্দা ও তথ্য প্রযুক্তির কার্যক্রমে তথ্য পাওয়া যায়, আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক এবং অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে আসছেন।

সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের একটি টিম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জানতে পারে যে, শনিবার সন্ধ্যার পর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় তারা একত্রিত হবে। এরপরই একটা রুদ্ধশ্বাস অভিযানের মধ্য দিয়ে তাদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইজাজ কারগিলের হাত ধরে জঙ্গিবাদে আনিস

নায়েবে আমীর সাখাওয়াতুল কবিরের জঙ্গিবাদে জড়ানো সম্পর্কে আসাদুজ্জামান বলেন, তার জঙ্গি জীবনে জড়ানোর ইতিহাস দীর্ঘ। আনসার আল ইসলামের মাতৃ সংগঠন জমিয়তে মুসলিমীন। ২০০২ সালে জমিয়তে মুসলিমীন আত্মপ্রকাশের পর এ সংগঠনটি থেকেই আনিস জঙ্গিবাদের দীক্ষা পান। 

জমিয়তে মুসলিমীনের তৎকালীন আমীর ছিলেন ইজাজ আহমেদ কারগিল। তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনিস জঙ্গিবাদে যুক্ত হন। শেষ সময় পর্যন্ত ইজাজ কারগিলের সঙ্গে ছিলেন নায়েবে আমীর আনিস। বাংলাদেশে আনসার আল ইসলামের প্রথম আমীর কিন্তু এই ইজাজ কারগিল। তিনি পাকিস্তানে ড্রোন হামলায় নিহত হন। ২০১০ সালে ইজাজ কারগিল আনসার আল ইসলামের আমীর নিযুক্ত হন। তখন এই আনিসকে নায়েবে আমীর নিযুক্ত করা হয়।

২০১৪ সালে ইজাজ কারগিল পাকিস্তানে চলে যান। পরবর্তী সময়ে ইজাজ কারগিলের মাকে নিয়ে আনিস পাকিস্তানে চলে যান। ড্রোন হামলায় ইজাজ কারগিল মারা যাওয়ার পর আনিস বাংলাদেশে ফিরে এসে আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম শুরু করেন।

২০১৫ সালে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সাখাওয়াতুল কবির

২০১৫ সালে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান আনিস। কারাগারে থাকাকালেও তার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ২০১৮ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েই আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম শুরু করেন। সেসময় কিন্তু আনসার আল ইসলাম নতুন ফর্মে কার্যক্রম শুরু করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পুনরায় শূরা সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।

২০১৯ সাল থেকে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন সংগঠনের উত্থাপন ঘটছিল। ইজাজ কারগিল ও শামিন মাহফুজ ওরফে শামিনসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতার সঙ্গে আনিসের যোগাযোগ ছিল।

জামায়াতুল আনসারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আনিসকে দায়িত্ব দেয় আনসার আল ইসলাম

আনসার আল ইসলাম যখন জামায়াতুল আনসার নামক সংগঠন সম্পর্কে জানতে পারে, তখন যোগাযোগ রক্ষার জন্য আনিসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতঃপূর্বে শারক্বীয়ার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেসব বৈঠকের নেতৃত্ব দিতেন এই আনিস। তার মাধ্যমেই আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন তথা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য টাকা দেওয়া হতো।

পরবর্তী সময়ে শামিনকে আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতাও দেওয়া হতো। সেই ভাতার টাকা শামিনের হাতে পৌঁছে দিতেন আনিস।

অপারেশন বিভাগের ঢাকা অঞ্চলের প্রধান সাইফ

আনসার আল ইসলামের আশকারী বিভাগ নামে একটি শাখা আছে। এ শাখার সদস্যরা অপারেশন পরিচালনা করেন। এই অপারেশনাল টিমের কমান্ডার ছিলেন ইহছানূর রহমান ওরফে মুরাদ ওরফে সাইফ।

সাইফ সম্পর্কে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ২০২০ সালে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন সাইফ। তিনি ২০১৭ সালেই আনসাল আল ইসলামে যুক্ত হন। এরপর থেকে তিনি সাংগঠনিক দক্ষতায় ২০২২ সালে আনসার আল ইসলামের আশকারী বিভাগের ঢাকা অঞ্চলের প্রধান হন।

সাইফকে আনসার আল ইসলামের ফুলটাইম মেম্বার হিসেবে উল্লেখ করে সিটিটিসি প্রধান বলেন, তিনি সপরিবারে আত্মগোপনে ছিলেন। ২০১৮ সাল থেকে পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। আত্মগোপনে থেকেই তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন। তার আর কোনো পেশা ছিল না। তিনি ছিলেন আনসার আল ইসলামের ফুলটাইম মেম্বার। সংগঠনের অন্যান্য আশকারী সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, নতুনদের রিক্রুট করা ও দাওয়া বিভাগে উদ্বুদ্ধ করার কাজ তার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।

হোমিও চেম্বারের আড়ালে সাভারে চলছিল আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম

গ্রেপ্তার বখতিয়ার রহমান ওরফে নাজমুলের বাড়ি দিনাজপুরে। তিনি সাভারে থাকতেন। আমাদের অপারেশনাল টিম তার সন্ধান পাওয়ার পর তিনি সাভারে অভিযানে যান। সাভারে ভাড়া বাসায় তিনি হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিস করতেন। অপারেশনাল টিম সেখানে গিয়ে দেখে তার হোমিওপ্যাথি চেম্বার বন্ধ। পরে খবর দেওয়া হয় একজন রোগী আছে, নাজমুলকে জরুরি দরকার। এজন্য এক ব্যক্তিকে রোগী সেজে পাঠানো হয়েছিল। এরপর স্ত্রীর দেওয়া খবরে নাজমুল আত্মগোপনে চলে যান। সেই নাজমুলকে বৈঠকে থাকা অবস্থায় যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আরামবাগ হাইস্কুলে নিয়োগ পেয়েছিলেন জয়দেবপুর অঞ্চলের দাওয়াহ বিভাগের প্রধান জাহেদুল

জাহেদুল ইসলাম ওরফে আশ্রাফ কয়েকদিন আগে আরামবাগ হাইস্কুলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি জয়দেবপুর অঞ্চলের দাওয়া বিভাগের প্রধান। তিনি সাভারের একটি সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই সেলটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার আশপাশের অঞ্চলে আনসার আল ইসলামের বেশ কয়েকটি সেল সক্রিয়। তার মধ্যে সাভার অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স করা জাহেদুল ইসলাম ওরফে আশ্রাফ ২০১৫ সাল থেকেই ছাত্রাবস্থায় আনসার আল ইসলামে যুক্ত।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল। আনসার আল ইসলামের এই শীর্ষ পাঁচ নেতাকে গ্রেপ্তারের ফলে আমরা তাদের অনেকটাই দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছি।

সিটিটিসি জানিয়েছে, গ্রেপ্তার আনসার আল ইসলামের সদস্যরা ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে অত্যন্ত গোপনীয়তায় মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। 

আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র-গুলির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তাদের ঢাকায় আস্তানাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা কৌশলে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আজ (রোববার) তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাব বলে আমরা আশাবাদী।

জেইউ/কেএ