ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের বাস্তবায়নে বাংলাদেশের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত অগ্রগতি দৃশ্যমান। তবে আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভাবনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এর অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদ (আনকাক) বাস্তবায়ন পর্যালোচনা বিষয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০০৪ সালে সরকার কর্তৃক দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রণীত হয়। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদে স্বাক্ষরের পর একই বছর দুর্নীতি দমন নীতিমালা প্রণীত হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন, এরপর ২০১১ সালে জনস্বার্থ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন, ২০০৮ সালে ক্রয় বিধিমালা, ২০১২ সালে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণীত হয়। আইন প্রণয়নের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ বাস্তবায়নের দিক থেকে আরো অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন, ২০০৪ অনুযায়ী দুর্নীত দমনে বিশেষায়ীত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে দুর্নীতি দমন কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত। তবে কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে এর আইনগত বাধা যেমন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতির আইনগত বাধ্যবাধকতা দূর করতে হবে। অন্যদিকে, দুদকের ওপর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  একটি দক্ষ সিভিল সার্ভিস গঠনে ইতিপূর্বে যেসকল আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সিভিল সার্ভিস নীতিমালা ১৯৮১ ও সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এবং এর ভিত্তিতে গৃহীত বিভিন্ন বিধি অন্যতম। এছাড়া সাম্প্রতিককালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এবং জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতির বিষয়টি দুর্নীতি দমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, জনপ্রতিনিধত্ব আদেশ এবং নির্বাচন আচরণবিধি এবং পরবর্তীতে নির্বাচন ব্যয় বিষয়ক অধ্যায় সংযোজন করা হয় এবং নির্বাচন ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এর সংশোধন আনা হয়। তবে দলীয় প্রধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে ২০০৬ সালে সরকারি ক্রয় আইন প্রণয়ন, ২০০৮ সালে সরকারি ক্রয় বিধিমালা প্রবর্তন এবং ই-জিপি প্রবর্তন করা হয়। তবুও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশের সঙ্গে ক্রয় প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণকারী সরবরাহকারীদের জোগসাজশের কারণে সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ই-জিপির ফলে প্রকৃত উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত বিরল, বরং ক্রয় প্রক্রিয়ায় এক ধরনের জবরদখলের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও ২০০৭ সালে প্রথম এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। তবে আনুষ্ঠানিক পৃথকীকরণ হলেও এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও নির্বাহী প্রভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নিম্ন আদালতে সেবাগ্রহীতাদের ব্যাপক দুর্নীতির শিকার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থ পাচার প্রতিরোধে ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রবর্তিত এবং ২০১২ ও ২০১৫ সালে এর সংশোধন এবং ২০১৯ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালার প্রণয়নের মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য আইনগত কাঠামো তৈরি হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট  প্রতিষ্ঠা এবং এগমন্ট গ্রুপে বাংলাদেশের সদস্যপদ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করে। তবে আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাচারকৃত অবৈধ অর্থের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, পরিচালক শেখ মঞ্জুর ই আলম, এডভাইজ এক্সিকিউটিভ ডা.সুমাইয়া, গবেষক ফাতেমা আফরোজ প্রমুখ।

এএসএস/এমএসএ