দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ/ ছবি : সংগৃহীত

পাওনা সাড়ে ৬ হাজার টাকা আদায় করতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন অভিযোগে আদালতে মামলা করেন গৃহকর্মী রণি আক্তার (তানিয়া)। এ মামলায় গ্রেপ্তার হন দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরই থানা হেফাজতে মারা যান তিনি। যদিও পরিবারের দাবি পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।

গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করার পর ২৭ সেপ্টেম্বর আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছিল। আদালত অভিযোগটি ৩২৩ ধারায় আমলে নেন। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার মাধ্যমে ইস্যু করে আদালতের পরোয়ানায় ৩০ অক্টোবর আসামিকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু গত মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে সাদা পোশাকে পুলিশের কয়েকজন সদস্য দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান। 

সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরিবারের অভিযোগ, তাকে ৩০ অক্টোবর আদালতে হাজির করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তাও মধ্য রাতে! দুদকের উপ-পরিচালক হিসাবে ২০১৮ সালে অবসরে যাওয়া ৬৪ বছরের একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে এভাবে কেউ গ্রেপ্তার করতে পারে না। তিনি সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি, তাকে আদালতের পরোয়ানা দেখালেই স্বাভাবিকভাবে আদালতে হাজির করা সম্ভব। মূলত জমি-জমা নিয়ে বিরোধের জের ও ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে। 

এ বিষয়ে শহীদুল্লার ছেলে নাফিস শহীদ বলেন, ‘আমাদের জমি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে বিরোধ ছিল। তবে মামলার বিষয়টি আমরা জানতাম না। বাবাও আমাদের জানাননি। মঙ্গলবার রাতে কয়েকজন পুলিশ গিয়ে বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। থানায় পৌঁছানোর পর পুলিশ ফটক বন্ধ করে দেয়। বাবার ওষুধ নেওয়া হলে পুলিশ সেগুলো বাবাকে দেয়নি। পরে রাতে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাবার মৃত্যু হয়।’

এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা থাকবে। বিষয়টি অবশ্যই তার পরিবার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে প্রত্যাশা করি।’

এ ঘটনাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহার উল্লেখ করে দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (ডুসা) সভাপতি মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দুদক পরিবারের সদস্য শহীদুল্লার পুলিশ হেফাজতে করুণ মৃত্যুর বিবরণ উঠে এসেছে। আটকের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হয়নি। ঘটনা যদি সত্য হয় তবে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধ।’

তিনি বলেন, ‘সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা তাকে মধ্যরাতে থানায় নিয়ে যায়। মামলার পরবর্তী তারিখ আরও ২৭ দিন পরে থাকার পরও ৬৪ বছরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মধ্য রাতে গ্রেপ্তার করা, পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া, হার্টের রোগী হিসেবে ওষুধ নিতে না দেওয়াসহ নানাবিধ ঘটনার পর তার মৃত্যু অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ।’

দুদকের সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যুর বিষয়ে নগর পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোখলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে একটি সিআর মামলায় আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে দুদকের সাবেক ডিডি শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। থানায় আনার পর তিনি অসুস্থ বোধ করলে তাকে প্রথমে ওসির রুমে বসানো হয়। সেখানে তার স্বজনরা আসেন। এরপর স্বজনদের নিয়ে অটোরিকশাযোগে তাকে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

আদালতে দায়ের করা মামলায় যা আছে

গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলায় দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও তার আত্মীয় মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযোগকারী রণি আক্তার তানিয়া সংসারের অভাব অনটনের কারণে অপর ভিকটিম কলি আক্তারসহ একই বাসায় সাবলেট থাকেন। শহিদুল্লাহর বাসায় সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাসিক ৩ হাজার টাকা বেতনে গত জানুয়ারি মাস থেকে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ নেন। 

মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, গৃহকর্মী তানিয়াকে দিয়ে ১২টার পরও অতিরিক্ত কাজ করিয়েছেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের নিয়মিত বেতন দিলেও পরবর্তীতে এক হাজার বা ১৫০০ টাকা করে পরিশোধ করা হয় এবং বেতন বকেয়া রাখা হয়েছে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ৫০০ টাকা বকেয়া ছিল। বকেয়া টাকা চাইলে নানা বাহানা করতে থাকেন। গত ১২ আগস্ট শহিদুল্লাহর স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার রাতে টাকা দেওয়ার কথা বলেন। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টায় তানিয়া কলিকে সঙ্গে নিয়ে শহিদুল্লাহর বাড়িতে যান। বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে হবে এমন কথা বলে বকেয়া টাকা দাবি করেন। কিন্তু টাকা না দিয়ে তানিয়াকে চড়-থাপ্পড় মারেন আসামিরা। এক পর্যায়ে গলা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় ভিকটিম কলি আক্তার তানিয়াকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে তার পেটে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। 

এজাহারে কলিকে গর্ভবতী উল্লেখ করা হয়েছে। কলি আক্তারের চিৎকার শুনে দ্বিতীয় আসামি কাওসার আনোয়ার আসলে তিনিও কিল-লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ঘটনার এক পর্যায়ে কাওসার আনোয়ার বাসার ভেতর থেকে ধারালো ছুরি নিয়ে এসে তানিয়ার উরুতে আঘাত করে জখম করেন। এছাড়াও প্রধান আসামি সাবেক দুদক কর্মকর্তা শহিদুল্লাহ মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে চিকিৎসা নেন এবং সুস্থ হয়ে থানায় পুলিশ মামলা করতে গেলে তা গ্রহণ না করায় আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন এবং আদালত ৩২৩ ধারায় অভিযোগ আমলে নেন।

এর আগে গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় নিজের আবাসস্থল ভাঙচুর ও ৫০ লাখ টাকা চাঁদার দাবির অভিযোগে মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। 

পরিবারের অভিযোগ, এ মামলার জেরেই তাকে হেনস্তা করতে গৃহকর্মীকে দিয়ে আদালতে মামলা করানো হয়েছে।  

৩২৩ ধারায় কী আছে?

দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারায় স্বেচ্ছায় আঘাত দানের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা আছে, ভোতা অস্ত্র দ্বারা যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে আঘাত করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ৩২৩ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা যাবে। কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় আঘাত দান করে তাহলে তার শাস্তি হবে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড। আর এই ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য।

আরএম/এসকেডি