চট্টগ্রামে মো. হাসান (৬০) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তার বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৩২)। বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনি এ জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বাবাকে হত্যার কারণ, মরদেহ টুকরো টুকরো করা এবং খণ্ডিত দেহের খণ্ডিত অংশগুলো কীভাবে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তার বর্ণনা দেন। 

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা দুই ভাই ও এক বোন। আমি সবার বড়। আমার বয়স যখন ৬ থেকে ৭ বছর, তখন আমার বাবা শহরে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। বাবার কোনো খোঁজ খবর পাইনি। অনেক বছর ফিরে না আসায় এলাকার মানুষ মনে করতেন বাবা মরে গেছেন হয়ত। আমরা মায়ের এবং দাদির কাছে বড় হই। আমি কৃষি কাজ করি। ছোট ভাই মো. শফিকুর রহমান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে গার্মেন্টসে চাকরি করে। বোন রাজিয়া বেগমকে বাঁশখালী থানার চাম্বলে বিয়ে দিই। 

দীর্ঘদিন বাবা ফিরে না আসায় আমার মা বাড়িতে বাপের ভিটায় বসবাস করতেন। আনুমানিক ২৮ বছর পর বাবা ফিরে আসেন। বাবা নিখোঁজ থাকায় জেঠা মাহবুব আলী ও জেঠি রাবেয়া বেগম আমাদের অত্যাচার করে ভিটা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তারা আমার পরিবারের জিনিসপত্র নিয়ে যেতেন। হাঁস-মুরগি নিয়ে যেতেন। আমরা কোথাও বিচার দিলে বিচার পেতাম না। তারা আমাদের ভিটে-মাটি কেটে ফেলে দিতেন। আমাদের পুকুরের মাছ খেতে দিতেন না। সবাই নির্যাতন করতো। বাবা চলে যাওয়া তিন বছর পর আমার দাদি মারা যায়। দাদিকে আমার মা সেবা করতেন এবং ভিক্ষা করে এনে খাওয়াতেন। ভাই-বোনরা বড় হই মানুষের কাজ করে। বোনকে বিয়ে দিয়েছি ১২ থেকে ১৩ বছর আগে। সেখানে সংসার না হওয়ায় পুনরায় আবার বিয়ে দিই। ছোট ভাই নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে। আমি ২০১৯ সালে বিয়ে করি। আমার সাত মাসের ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী তার বাপের বাড়ি চলে যায়, এরপর আমি আর বিয়ে করিনি।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে লাগেজে পাওয়া খণ্ডিত মরদেহের পরিচয় মিলেছে

বাবা গত দুই বছর আগে বাড়িতে ফিরে আসেন। তখন আমরা সমাজের সৈয়দ আলম, দেলোয়ার আহম্মদ, আবু সালেহ, শুকুর ও বক্করদের ডাকি। তারা এসে আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কি আবার চলে যাবা নাকি এখানে থাকবে’। তখন আমার বাবা বলে ছেলে মেয়েরা যেভাবে বলে সেভাবে চলবো। এরপর বাবা আমার মাকে বলে ওনার আরেকটা সংসার রয়েছে। তিনি আমার মাকে নানা এলোমেলো কথা বলেন। আমার মাকে তালাক দিয়ে দেবে বলেন। এভাবে দুই মাস চলার পর উনাকে আমরা ইতিকাপে রাখি। তখন কাপড়-স্যান্ডেল সব কিনে দিই। এরপর আমি বাবাকে বলি চাকরি করতে, কিন্তু উনি বলেন চাকরি করবে না। বলেন যে এতদিন জাহাজে চাকরি করতেন, সেখানে চলে যাবেন। এভাবে তিনি ৭-৮ মাস আমাদের বাড়িতে ছিলেন। তারপর তিনি জাহাজে যাবেন বলে বাড়ি থেকে পুনরায় চলে যান। আমাদের সঙ্গে তখন কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে আমার জেঠা-জেঠির যোগাযোগ ছিল। কারণ আমাদের বসতভিটের বাড়ির অংশ আমার জেঠা-জেঠি কিনতে চান, আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। তিন মাস পর বাবা আবার বাড়িতে ফিরে আসেন। এসে আমাদের ঘরে না থেকে অন্য মানুষের ঘরে থাকেন। কিন্তু তখন আমাদের বাড়িতে খাবার খেতেন। প্রায় সময় আমার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করতেন। ১০-১৫ দিন এভাবে থাকার পর কাউকে না বলে আবার তিনি বাড়ি থেকে চলে যান। দেড় মাস পরে আবার ফিরে আসেন। এসে বাইরে বাইরে থাকেন। এলাকার মেম্বার আমার ছোট ভাইকে ডেকে বুঝিয়ে দিলে সে বাবাকে ঘরে নিয়ে আসে। বাড়িতে ফিরে বাবা আমার মায়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া শুরু করে এবং ভিটা বিক্রি করবে বলে হুমকি দেয়। 

৫-৬ দিন থাকার পর আমার মা বাড়িতে না থাকা অবস্থায় বাবা আবার চলে যান। বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমার মা এবং ছোট ভাইকে কল দিয়ে ভিটা বিক্রি করে দেবে বলেন। আরও বলে তোরা আমার সন্তান না। তার ২০-২২ দিন পরে আমার বাবা ছোটো ভাইয়ের শহরের বাসায় ঘটনাস্থলে আসেন। তখন মা চিকিৎসার জন্য ওই বাসায় ছিলেন। বাবা আসেন ১৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টায়। আমি তার আগে রাত আটটার সময় ছোটো ভাইয়ের বাসায় আসি। ছোট ভাই বলেছিলেন আব্বার সঙ্গে কিছু কথা আছে, তাই আমি বায়েজিদ হয়ে আকমল আলী রোডের বাসায় আসি। বাবা বাসায় এসে ভাত খেয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টায় আমি বাইরে দোকান থেকে নাস্তা খেয়ে বাসায় থাকি। আটটায় আমি রুমে যাই। গিয়ে দেখি বাবা এবং ছোট ভাই খাটে বসা। তখন রুমে আমি সহ তিনজন। আমরা পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে থাকি। একপর্যায়ে বাবা বলে তোরা আমার সন্তান না। 

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে লাগেজে মিলল খণ্ডিত মরদেহ

এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি চলতে থাকে। বাবা আমাকে গালে থাপ্পড় মারে। আমার মাথা তখন গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে না পেরে আমি দুই হাত দিয়ে বাবার গলা চেপে ধরি। এক চাপে বাবা মরে যায়। এরপর খাটের নিচে থাকা মুড়ির প্লাস্টিকের বস্তা বের করে প্রথমে বস্তায় ঢুকিয়ে মরদেহ রুমের কোণে রেখে দিই। রুম তালা দিয়ে বাইরে চলে যাই। ছোট ভাই তার রুমে চলে যায়। বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে থাকি লাশটাকে কি করা যায়। ওইদিন বিকেল ৩টার সময় ছোট বোনের স্বামী ফোরকানকে কল দিই অটোরিকশা আনার জন্য। ওই গাড়িতে মাকে উঠিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার সময় ছোট ভাই বাবার লাশের বস্তাটা তার রুমে নিয়ে যায়। আমি ও আমার ছোটভাই লাশটা কী করব এ নিয়ে কথা বলার সময় ছোট ভাইয়ের বউ বলে তোমরা জান। দুই ভাই মিলে বুদ্ধি করি লাশ কি করব? লাশ তুলে দেখি বেশি ভারী। তখন চিন্তা করি লাশ কীভাবে সামলাবো? সিদ্ধান্ত নিই লাশটাকে টুকরো টুকরো করে দূরে নিয়ে ফেলে দেব। ছোট ভাইকে পলিথিন আর টেপ আনতে পাঠাই। এরপর ঘরে থাকা দা দিয়ে আমি প্রথমে চেহারা না দেখার জন্য মাথায় গামছা দিয়ে মাথা কাটি, তারপর দুটি হাত ও হাঁটুর ওপর থেকে পা কাটি। তারপর হাতটা ৪ টুকরা আর পা ৪ টুকরা করি। আগে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে বডি প্লাস্টিকের চালের বস্তায় ঢুকাই। রাত তিনটার সময় আমার ছোটো ভাই একজন মাদকাসক্ত লোক আনে। তাকে দিয়ে দেহের বস্তাটা খালে ফেলে দেওয়া হয়। হাত ও পায়ের ৮ টুকরো টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ছোট ভাইয়ের বউয়ের লাগেজে ভরি। মাথা লাগেজে ঢুকাতে না পেরে একটা শপিং ব্যাগে ভরে রুমের কোণায় রেখে দিই। আমার ভাই বলে মাথা সে ফেলবে। পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর ফজরের আজানের পর ছোটো ভাইয়ের বউ আর আমি প্রথমে রিকশায়, তারপর ক্রসিং থেকে সিএনজি করে ১২ নম্বর ঘাটের পাশে নেমে লাগেজ নিয়ে নেমে যাই এবং রাস্তার পাশে ফেলে দিই।

ছোট ভাই ও তার বউ ১৫ নম্বর ঘাটে যায়। আমি বাড়িতে চলে যাই। বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে যাই। মা নানার বাড়িতে ছিল। মা আমাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি মেরে ফেলেছি, মা কপালে হাত মেরে কান্না করে। শুক্রবার ভাইকে বাড়িতে যেতে বলি এবং সে মোবাইল ফোন ধরে না। আবার মাগরিবের পরে কল দিই। তখন পুলিশ আমাদের মেম্বার সৈয়দকে কল করে। মেম্বার আমাকে ডেকে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে দেন। পুলিশ আমাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞাসা করে। আমি বলি জাহাজে। যোগাযোগ রয়েছে কি না জানতে চান। পরদিন নানা বাড়ি থেকে আমাকে এবং মাকে পুলিশ নিয়ে আসে। রিমান্ডে যাওয়ার পর জানতে পারি আমার বাবার লাশ জেঠা মাহবুব আলীসহ সৈয়দ মেম্বর নিয়ে যায় এবং আমাদের ঘরের ভেতরে কবর দেন।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় মানুষের শরীরের কিছু খণ্ড পাওয়া যায়। এরপর তার পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত ভুক্তভোগী স্ত্রী ও ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ড শেষে আজকে (বুধবার) দুজনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এর মধ্যে ভুক্তভোগীর ছেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এমআর/এসএম