‘ক্রোক বিজ্ঞপ্তি’ লাগিয়ে ওসি আব্দুল্লাহ’র সম্পদ ক্রোক শুরু
ফেনী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের ক্রাইম শাখার পুলিশ পরিদর্শক ও পিরোজপুর মঠবাড়িয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের নামে থাকা অবৈধ সম্পদ ‘ক্রোক বিজ্ঞপ্তি’ লাগিয়ে ক্রোক করা শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আদালতের নির্দেশনায় এরই মধ্যে সৈয়দ আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে থাকা দুটি বিশাল ফ্ল্যাট ক্রোক করেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- কাকরাইলের আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন লিমিটেডের ১৪তলা বাণিজ্যিক ভবন গ্রিন সিটি রিজেন্সির (২৬,২৭, ২৭/১ কাকরাইল) তৃতীয় তলায় দুই হাজার ১২০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিংয়ের ২৬৬ বর্গফুটসহ মোট ২ হাজার ৩৮৬ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেস এবং ঢাকার বড় মগবাজারে এবিসি রিয়েল এস্টেটের দ্য ওয়েসিস কমপ্লেক্স টাওয়ারের (ইস্পাহানি কলোনি, ৩৯ বড় মগবাজার) ১০ম তলায় দুই হাজার ১৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এছাড়া তার অন্যান্য স্থাবর সম্পদও ক্রোক করবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ আব্দুল্লাহ, তার স্ত্রী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে সোয়া ১৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চলতি বছরের ১৫ জুন দুদকের পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের তদারককারী কর্মকর্তা ও পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলা দায়ের করার পরে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে স্থাবর সম্পদের ক্রোক বিজ্ঞপ্তি লাগানো হয়েছে।
অন্যদিকে পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে রাজধানীতে টানানো ক্রোক সম্পত্তি নোটিশ সূত্রে দেখা যায়, গত ২৮ মে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের নির্দেশনায় সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে সর্বসাধারণের অবগতির জন্য বিজ্ঞ আদালতের এ আদেশ প্রচার করা হয়েছে। ক্রোক বিজ্ঞপ্তিতে ফ্ল্যাটের আয়তন, ঠিকানা, খতিয়ান ও সিটি জরিপের দাগ নং উল্লেখ করে বিবরণে লেখা আছে, ফারহানা আক্তারের নামে ওই সম্পদ কোনোভাবেই আর হস্তান্তর করা যাবে না। উক্ত ফ্ল্যাট সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকার লেনদেন বা উক্ত ফ্ল্যাট দায়বদ্ধ করা আইনত নিষিদ্ধ। প্রচারে: দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পিরোজপুর।
এ বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এরইমধ্যে ওসি আব্দুল্লাহর অস্থাবর অর্থাৎ ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ ফ্রিজ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের কাজ শুরু করা হয়েছে। দুদক আদালতের নির্দেশনা পালন করছে। ক্রোক করার আগে গত ৬ আগস্ট জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল।
জানা গেছে, আসামি সৈয়দ আব্দুল্লাহ ১৯৯১ সালে সাব-ইনস্পেক্টর পদে পুলিশে যোগ দেন। ২০০৭ সালে ইনস্পেক্টর পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ীয়া থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ফারহানা আক্তার ও শাশুড়ি কারিমা খাতুন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ মঠবাড়িয়া থানায় কর্মরত থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, মাদক ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা, মিথ্যা মামলার রেকর্ড ও অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদের অর্জনের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ২০২০ সালে কমিশন থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ আব্দুল্লাহ প্রতারণার উদ্দেশে স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে দুটি এনআইডি কার্ড তৈরি করে এর বিপরীতে পৃথক দুটি ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) গ্রহণ করেন। যা ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫ টাকা, এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩১ লাখ টাকায় গাড়ি ক্রয়সহ মোট তিন কোটি সাত লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ ক্রয় করেন। এছাড়া নিজ নামে দুটি প্লট, স্ত্রীর নামে দুটি আবাসিক ফ্ল্যাট, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ পরিশোধ করে শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে একটি আবাসিক ফ্ল্যাট বাবদ মোট ১৫ কোটি সাত লাখ ৬৪ হাজার ৪৩২ টাকার অধিক মূল্যের স্থাবর সম্পদ ক্রয়ের তথ্য পাওয়া যায়।
দুদকের অনুসন্ধানে এসব স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে মোট ১৮ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ২৮৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য মেলে।
আসামি সৈয়দ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী হিসেবে পুলিশে কর্মরত থাকা অবস্থায় পদমর্যাদার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে নিজের নাম, স্ত্রী ও শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে সম্পদ গড়েছেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি অর্থের উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করার চেষ্টা করেছেন। যেখানে তার স্ত্রী ও শাশুড়ি সরাসরি সহযোগিতা করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
চলতি বছরের ২৮ মে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত সৈয়দ আব্দুল্লাহর অপরাধলব্ধ আয়ের মাধ্যমে অর্জিত মোট ১৮ কোটি ১৬ হাজার ৫৬৩ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন। একই সঙ্গে সৈয়দ আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নিজ নামের ট্যাক্স ফাইলগুলো জব্দ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে মামলায় দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪২০/১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২), ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
ওসি সৈয়দ আব্দুল্লাহ, তার স্ত্রী ও শাশুড়ির যত অবৈধ সম্পদ
দুদকের অনুসন্ধানে তাদের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন কোটি আট লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং আসামি সৈয়দ আব্দুল্লাহর নিজ নামে দুটি প্লট, স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে রাজধানীতে দুটি ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্পেস, শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যার মধ্যে রয়েছে- আব্দুল্লাহর শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে গুলশানে নাভানা রিয়েল এস্টেটের নাভানা এসিলমন প্যালেস নামের ১৩তলা ভবনের ১২তম তলায় তিন হাজার ৯০৯ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে কাকরাইলের আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন লিমিটেডের ১৪তলা বাণিজ্যিক ভবন, গ্রিন সিটি রিজেন্সির তৃতীয় তলায় দুই হাজার ১২০ বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস ও ২৬৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিংসহ মোট দুই হাজার ৩৮৬ বর্গফুট জায়গা, ঢাকার বড় মগবাজারে এবিসি রিয়েল এস্টেটের দ্য ওয়েসিস কমপ্লেক্স টাওয়ারের ১০ম তলায় দুই হাজার ১৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিং, খিলগাঁওয়ের পশ্চিম নন্দীপাড়ায় দুই হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট ও গ্যারেজ এবং সৈয়দ আব্দুল্লাহর নিজ নামে নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটিতে ছয় কাঠার দুটি প্লট।
এছাড়া স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, ফিনিক্স ফাইন্যান্স লিমিটেডে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত, খুলনার অগ্রণী ব্যাংকের বয়রা বাজার শাখায় ৫০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিজয়নগর শাখা, অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিস শাখা ও বয়রা বাজার শাখা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোড শাখা, সোনালী ব্যাংকের ভিকারুননিসা নূন স্কুল শাখা এবং খুলনার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বিভিন্ন আমানত হিসাবে ২৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৪ টাকার তথ্য রয়েছে।
আরএম/জেডএস