শুক্রবার পালিত হবে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস/

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও একই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু টানা তিন দফায় প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও দেশ নিরক্ষরমুক্ত হয়নি। উল্টো এখনো অনেক দেশের চেয়ে ঢের পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় এসডিজির শর্ত ২০৩০-এর মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২৩.২ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। এই হিসাবে মোট জনসংখ্যার চার কোটির বেশি মানুষ নিরক্ষর। সরকার মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২১ লাখ মানুষকে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তা সফল হয়নি। আট থেকে ১৪ বছর বয়সী স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের নিরক্ষরমুক্ত করার কর্মসূচি চালু রয়েছে। তবে ১৫ বছর বয়সের উপরের নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার কোনো কার্যক্রম নেই। এ ধারা চলমান থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

আগামীকাল ৮ সেপ্টেম্বর ‘পরিবর্তনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সাক্ষরতার প্রসার’ স্লোগানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এ উপলক্ষ্যে আজ বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে স্বাক্ষরতা দিবসের কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরবেন প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।

চার কোটি মানুষ নিরক্ষর

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটেসটিক ২০২২’ অনুযায়ী দেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক আট শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। 

শিক্ষায় অংশগ্রহণ ও ভর্তির হার বাড়লেও সাক্ষরতার হারে উল্টো গতি দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। 

অন্যদিকে গত বছরের ২৭ জুলাই প্রকাশিত বিবিএস জনশুমারি ও গৃহ গণনার তথ্য অনুযায়ী, সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রতিমন্ত্রীর দাবি করা তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের চেয়ে এবার সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের হার বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৯৯০ সালে ৩৫ দশমিক তিন শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮ দশমিক ছয় শতাংশ, ২০২০ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৫ দশমিক ছয় শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনের অন্যতম শর্ত দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা। কিন্তু সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বাংলাদেশে সাক্ষরতা কার্যক্রম আরও সীমিত হয়ে এসেছে। বিশাল এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে স্বাক্ষর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে মন্ত্রণালয়ের নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত আছে। এজন্য নানা ধরনের প্রকল্প চলমান।

সাক্ষরতার সংজ্ঞা কী 

ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুযায়ী সাক্ষরতা হলো, পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝায়। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করতে জানা।

সাক্ষরতা নিরূপণে সরকারি সংজ্ঞা এবং বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে।

বিবিএসের জরিপ নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিবিএসের সাক্ষরতা জরিপে সেলফ রিপোর্টেড সমীক্ষায় ‘আপনি কি লিখতে পারেন- এমন প্রশ্ন এবং ‘ইয়েস ও ‘নো’ উত্তরের ওপর ভিত্তি করে সাক্ষরতার হার নির্ণয় করা হয়। আর ‘টেস্টেড’ সমীক্ষায় ব্যক্তিকে লেখানো ও পড়ানো হয়। এর ভিত্তিতে গণনাকারী সাক্ষর ব্যক্তিকে শনাক্ত করেন। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বিবিএস প্রকাশিত হারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

সাক্ষরতা বাড়াতে যত প্রকল্প

দেশে সাক্ষরতা সংক্রান্ত কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফই)। প্রতিষ্ঠানটি  দেশের ৬৪ জেলায় নির্বাচিত ২৪৮টি উপজেলার ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৪৪ লাখ ৬০ হাজার নিরক্ষরকে ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা)’ মাধ্যমে সাক্ষরতা আওতায় এনেছে।  

গত বছরের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এজন্য ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪ (পিইডিপি ৪) এর আওতায় আট থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সী বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী এবং যারা কখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি এ ধরনের ১০ লাখ শিশুর মধ্যে মাত্র এক লাখ শিশুকে শিক্ষাদান করা হয়েছে। পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে ছয়টি জেলায় এ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ প্রকল্প নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় জিপিই’র আর্থিক এবং ইউনিসেফ’র কারিগরি সহায়তায় কক্সবাজার জেলার ১৪-১৮ বছর বয়সী ‘বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের জন্য দক্ষতা কেন্দ্রিক সাক্ষরতা’ একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আগস্ট ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত।

এ প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৮২৫ জনকে দক্ষতা কেন্দ্রিক সাক্ষরতা প্রদান করা হবে। এছাড়া দেশের শিশু ও বয়স্কদের নিরক্ষরমুক্ত করার কোনো কর্মসূচি নেই সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের হাতে।

জানতে চাইলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০টি প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু অনুমোদন না হওয়ায় নতুন কোনো কার্যক্রম নেই। ৮ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সী বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সাক্ষর করার প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানের নিরক্ষর মুক্ত করার সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষরতা হার বাড়ছে না।

তিনি আরও বলেন, জনবল সংকটে ভুগছে বিএনএফই। ৬৪ জেলার মাত্র ২৭ জেলা কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। বাকিরা অবসরে গেলেও নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। উপজেলা-থানা পর্যায়ে কোনো সেট আপ নেই।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিশেষজ্ঞ কে এম এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিবিএস তথ্যের সঙ্গে বাস্তব সাক্ষরতার হারের মিল নেই। বিবিএসের তথ্যকে আমরা বলে থাকি ‘সেলফ রিপোর্টেড’ তথ্য। সাক্ষরতার প্রকৃত চিত্র বের করতে হলে তা ‘টেস্টেড’ প্রতিবেদন হতে হবে। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী দেশের প্রতি চারজনে একজন নিরক্ষর। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হলে একজন মানুষও যেন নিরক্ষর না থাকে সে লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে। হাওর, পাহাড়, চরসহ দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষরমুক্ত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে সাক্ষরতা দিবস

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান প্রণীত হয় তার ১৭ নং অনুচ্ছেদে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাক্ষরতা বিস্তারে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৭৩ ঠাকুরগাঁওয়ে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানটি হয় ঠাকুরগাঁওয়ে। এ দিনে ঠাকুরগাঁও-এর কচুবাড়ী-কৃষ্টপুর গ্রামকে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরতামুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এদিকে এবারের সাক্ষরতা দিবসে (শুক্রবার) নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠান, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সংবাদ সম্মেলন, পোস্টার প্রকাশ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো আয়োজন ও প্রতিবেদন প্রকাশ ইত্যাদি।

এনএম/এসকেডি