ফাইল ছবি।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পাইলট প্রকল্পের আওতায় কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করার বিষয় সামনে রেখে মিয়ানমারের নেপিদোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক হতে যাচ্ছে। সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

ঢাকা ও নেপিদোর কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চীনের মধ্যস্থতায় যেকোনো সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে রাজি আছে মিয়ানমার। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় হিসাব-নিকাশ কষেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় ঢাকা। মিয়ানমারে হতে যাওয়া মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে শুরুতে কত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে চায় নেপিদো, প্রত্যাবাসন শুরুর পর পরবর্তী ব্যাচ শুরুর প্রক্রিয়া এবং রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফেরার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উদ্যোগ, বিশেষ করে ফেরত যেতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের আস্থা অর্জনের বিষয়ে জোর দেবে ঢাকা।

রোহিঙ্গা পরিবারের শিশু সদস্য / ছবি- সংগৃহীত

নেপিদোর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ২ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে নেপিদো গেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির। ৪ সেপ্টেম্বর প্রত্যাবাসন শুরু করাসহ রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে আলোচনা করতে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক হবে। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ফিরতি সফরে তাদের রাখাইনে ফেরানো নিয়ে মনোবল বাড়াতে নেপিদোর একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে কবে নাগাদ আসবে তা চূড়ান্ত হবে।

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর

ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, নির্বাচনের আগে কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পাঠাতে চায় সরকার। এখনও নিশ্চিত করে বলা যাবে না, ঠিক কবে থেকে এটা শুরু হবে। মিয়ানমারে মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠকের পর নেপিদোর একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজার সফর করবে। যেসব রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় রাখাইনে যেতে চান, তাদের তালিকা চূড়ান্ত হলে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল এসে তার জন্য কাজ করবে। মূল কথা মনোবল বৃদ্ধি, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এ বৈঠক থেকে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত হবে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না, এরপরও পর্যায়ক্রমে বৈঠক চলবে। এটা একটা প্রক্রিয়া।

প্রত্যাবাসন পরিবেশ দেখতে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মিয়ানমার যাচ্ছেন / ফাইল ছবি

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার রোহিঙ্গাকে রাখাইনে প্রত্যাবাসন করার জন্য তালিকা করেছে সরকার। এদের মধ্য থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হলে প্রথম ব্যাচে হাজার খানেক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই পরিবার এবং এলাকার রোহিঙ্গাদের পাঠানোর পক্ষে।

ঢাকার জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক বলেন, চীন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা নিয়ে খুবই আন্তরিক। মিয়ানমারের আন্তরিকতা দেখে ইতিবাচক মনে হচ্ছে। তবে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এর আগেও কিন্তু প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করেও সফলতা আসেনি। সেজন্য আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পা বাড়াতে হবে। প্রত্যাবাসন আমাদের মূল অগ্রাধিকার।

চীনের মধ্যস্থতায় গত চার থেকে পাঁচ মাস রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। বিষয়টিকে অনেক পশ্চিমা দেশ ‘তাড়াহুড়া’ হিসেবে দেখছে। কেউ কেউ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার প্রস্তাবও দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের রেখে দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে।

রোহিঙ্গাদের রেখে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের অগ্রাধিকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গাদের রেখে দেওয়ার প্রস্তাবে বাংলাদেশ কখনো রাজি হবে না। বরং যারা এ ধরনের প্রস্তাব দিচ্ছে, তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুতে ভূমিকা রাখা। তাছাড়া তারা তো চাইলে কিছু রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করতে পারে। এতে করে আমাদের ওপর থেকে কিছুটা চাপ কমত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে ভারত ও চীন। এটাকে দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশের সংকট বা মিয়ানমারের সংকট হিসেবে দেখলে হবে না। এটা তো রিফিউজি ক্রাইসিস, এটার স্পর্শকাতরতা বিশ্ব পর্যায়ে। যার ফলে, বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম থেকে এপ্রোচ করতে পারলে ভালো হতো। বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম থেকে যে জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত, সেটা থেকে আমরা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। সত্যিকারে এ সমস্যা সমাধানে যে ধরণের বহুপাক্ষিক এপ্রোচ নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা হয়নি।

শুধুমাত্র চীন নির্ভরতায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আসবে না বলে মনে করছেন অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান। তার ভাষ্য, শুধু চীনের ওপর নির্ভর করে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এটা করতে গেলে ওরা নিজেদের দরকষাকষির টুল হিসেবে ব্যবহার করবে।

চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়।

পরবর্তী সময়ে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওইসময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। সাত বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

চল‌তি বছর নতুন ক‌রে আবার রো‌হিঙ্গা‌দের প্রত‌্যাবাসন শুরুর বিষ‌য়ে বেশ উদ্যোগী ভূমিকা পালন কর‌ছে চীন। তারই অংশ হি‌সে‌বে এপ্রিলের মাঝামা‌ঝি‌তে কুনমিংয়ে বাংলা‌দেশ ও মিয়ানমার‌কে নি‌য়ে বৈঠক ক‌রে‌ছে চীন। ওই বৈঠ‌কে সিদ্ধান্ত হয় রো‌হিঙ্গা‌দের এক‌টি দল নি‌য়ে সরকা‌রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাখাই‌ন সফর কর‌বেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন সফর করেন। ফির‌তি সফ‌রে রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি দল পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সাইক্লোন মোখার কারণে সেটি পিছিয়ে দেয় মিয়ানমার। পরবর্তীতে গত ২৫ মে ১৪ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ঘুরে যান।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের অধিক রোহিঙ্গা। এছাড়া প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।

এনআই/এফকে