কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পর বাড়ি ফিরছেন মানুষ। লঞ্চের ছাদেও পা রাখার জায়গা নেই

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। আগামীকাল সোমবার থেকে এটি কার্যকর হবে। বিধিনিষেধের মধ্যে সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌপথে সবধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। সরকারের এমন ঘোষণায় রাজধানীর বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন ও সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।

করোনার সময় রাজধানীতে যাদের কাজ নেই মূলত তারাই আটকে পড়ার ভয়ে ছুটছেন বাড়ির পথে। ফলে বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন ও লঞ্চঘাটে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ মানুষের জটলা তৈরি হয়েছে। গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি ছিল টার্মিনালগুলোর সার্বিক চিত্র। ফলে যে উদ্দেশ্যে সরকারের কঠোর এই বিধিনিষেধ, সেটি কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অথচ ঠিকই আদায় হচ্ছে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া

ঠাঁই নেই লঞ্চে

রোববার সকাল থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীরা ভিড় করেছেন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। সবাই ঘরমুখী হওয়ায় লঞ্চের মধ্যেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ঠিকই ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে সবাইকে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বাড়ি ফেরার এমন চেষ্টায় মনে হচ্ছে রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে করোনার প্রকোপ এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বিস্তার করবে।

লঞ্চ টার্মিনাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাপ বেশি থাকায় আমরা চাইলেও নির্ধারিত যাত্রী তুলতে পারছি না। ঠেলেঠুলে যাত্রীরা উঠে পড়ছেন। এরপরও আমরা বারবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলছি। তবে যাত্রীদের অভিযোগ, ভাড়া দ্বিগুণ হলেও গাদাগাদি করে বেশি যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। অনেকে আবার ভালো জায়গা ধরার উদ্দেশ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টা আগে টার্মিনালে এসে অবস্থা করছেন।

লঞ্চের মধ্যেও একই চিত্র, স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণ নেই | ছবি- ঢাকা পোস্ট   

চাঁদপুরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চার ঘণ্টা আগে টার্মিনালে এসেছেন হাসনাত করিম। বলেন, একযোগে সবাই বাড়ি ফিরছেন। এ কারণে কেবিন পাওয়া যাচ্ছে না। ডেকে বা সিটে গাদাগাদি করে যেতে হচ্ছে। সবারই তাড়া বাড়ি ফেরার। 

‘স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সবাই জানলেও তা মানছেন না কেউ। সরকার গতকাল লকডাউনের ঘোষণা দেয়। এবার শুনছি খুবই কড়াকড়ি হবে। এ সময় ঢাকায় যাতে আটকে না পড়ি সে কারণে বাড়ি ফেরা। ভালো আসনের আশায় চার ঘণ্টা আগে এখানে আসা। কিন্তু আমার মতো অনেকেই আগে উপস্থিত হয়েছেন। আসলে কারোরই করার কিছু নেই।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পরিবহন বিভাগের উপপরিচালক এহতেশামুল পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যাত্রীদের সবসময় নির্দেশনা দিচ্ছি। প্রত্যেকটা লঞ্চে কড়াকড়ি নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবুও অভিযোগ আসছে যে যাত্রীরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।

কঠোর বিধিনিষেধের কারণে রাজধানী ছাড়ছেন মানুষ, রোববার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে তোলা ছবি 

গাবতলীতেও নেই স্বাস্থ্যবিধি, আছে ভাড়া বাড়ানোর অভিযোগ

এদিকে, গাবতলী বাস টার্মিনালেও যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে খুব একটা দেখা যায়নি। আছে ভাড়া বৃদ্ধির অভিযোগও।

সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রীদের সঙ্গে মাস্ক আছে কিন্তু সেটি পরিপূর্ণভাবে কাউকে পরে থাকতে দেখা যায়নি। কারও মাস্ক ঝুলছে থুতনিতে, আবার কারও হাতে। করোনাভাইরাসের প্রভাব মুক্ত থাকতে বিশেষজ্ঞরা অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে একজন আরেকজনের সঙ্গে লেপ্টে বসে থাকতে দেখা গেছে।

এদিকে, ভাড়া বৃদ্ধি, যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি ও নানা অসুবিধা নিয়ে বাস টার্মিনালে সেবা দিতে কাজ করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা।যেসব যাত্রীর সঙ্গে মাস্ক নেই তাদের মাক্স বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করছেন  পুলিশ সদস্যরা।

লকডাউন বা বিধিনিষেধ- কিছুই বোঝে না শিশুটি। বাবা-মার সঙ্গে বাড়ি ফেরা; তাই গাবতলীতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা  

পরিস্থিতি দেখতে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গাবতলী বাস টার্মিনালে আসেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে ঘুরে দেখেন। রাস্তার চলমান বাস থামিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলছে কি না, তা পরিদর্শন করেন। যাত্রীদের পরামর্শ দেন কোনো অসুবিধা হলে এখানে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে হানিফ পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার জহিরুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অতিরিক্ত নয়, আমরা আরও কম ভাড়া নিচ্ছি। ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির পর বরিশালের ভাড়া আসে ৮৬৯ টাকা। যাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা ৮০০ টাকা নিচ্ছি। তাহলে ভাড়া বৃদ্ধি কোথায় হলো?’

নাটোরগামী সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গাবতলী থেকে নাটোরের ভাড়া ৪০০ টাকা। ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ালে দাঁড়ায় ৬৪০ টাকা। কাউন্টারে গেলে বলা হচ্ছে টিকিট নাই। কিন্তু ব্ল্যাকে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় টিকিট মিলছে।’

বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত ১০) মোহাম্মদ জোবায়ের আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য দুটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের টিম এখানে আছে। অভিযোগ পাওয়ামাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আটটি মামলায় মোট ছয় হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে।

কখন আসবে গাড়ি, তারই অপেক্ষা। সামাজিক দূরত্ব মানার লক্ষণ নেই কারও মধ্যে

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা যখন টহল দেই তখন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। কিন্তু সরে যাওয়া পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। এখন তাদের সচেতন হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।’

আসন ফাঁকা রেখে বসছেন না ট্রেনের যাত্রীরাও

এদিন দুপুরে সরেজমিনে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, কাউন্টারে টিকিটের জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। তবে, স্টেশনে মাইকিং করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সচেতন করা হচ্ছে।

প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুহূর্তে চেক করা হচ্ছে টিকিট। তবে, সেখানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা শরীরের তাপমাত্রা মাপার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্ল্যাটফর্মগুলোতে ঢুকে যাত্রীরা অপেক্ষা করছেন। ট্রেন এলেই তারা উঠে পড়ছেন। ট্রেন ছাড়ার আগে জীবাণুনাশক ছিটানোর কথা। কিন্তু সেটিও মানা হচ্ছে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বনলতা এক্সপ্রেসের যাত্রী আরাফাত জানান, কাজ নেই তাই বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। স্টেশনে ঢোকার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ট্রেনের ভেতরেও আসন ফাঁকা রেখে কেউ বসছেন না।

বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরছেন, সামনের দিনগুলোতে কীভাবে চলবেন- সেই চিন্তা যেন ভর করেছে

কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. মাসুদ সারোয়ার বলেন, সকাল থেকে তেমন চাপ ছিল না। বিকেল থেকে চাপটা বেড়েছে। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও আমরা অনুরোধ করছি, আসন ফাঁকা রেখে বসার। স্টেশনে আজ সারাদিনে ৭২টি ট্রেন ছেড়ে যাবে এবং আসবে। যেসব ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে, তার অধিকাংশই যাত্রীতে ঠাঁসা।

পরিবহনে পরিবহনে ডাকাতির মহোৎসব চলছে : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইসহ কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ফলে করোনায় সংকটাপন্ন নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ সংগঠনটির।

রোববার (৪ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ অভিযোগ করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, শনিবার 'লকডাউন' ঘোষণা আসার পর থেকে দেশে বাস-টার্মিনাল ও কাউন্টারগুলোতে যাত্রী চাপ বাড়তে থাকে। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ সাপেক্ষে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের শর্তে গণপরিবহন চালানোর সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত। দূরপাল্লার যাত্রাপথে অধিকাংশ গণপরিবহনে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে যাত্রী সাধারণ অস্বাভাবিক ভাড়া ডাকাতির শিকার হচ্ছে। সরকার বাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ালেও সিটি সার্ভিসের গণপরিবহন মালিকরা সরকারি তালিকার পরিবর্তে তাদের ওয়েবিল নির্ধারিত আগের ভাড়া ওপর ১০০ শতাংশ যোগ করে আদায় করছে। ফলে এ ভাড়া কোথাও কোথাও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ১৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

এমএআর/