তিন বছরেও গৃহকর্মীর তথ্য সংগ্রহ করেনি পুলিশ
এখনও পরিচয় মেলেনি ‘নির্যাতনে নিহত’ গৃহকর্মীর, লাপাত্তা গৃহকর্ত্রী
রান্না ঘরে পানিতে ভেজানো ছিল শিং মাছ, পাত্রে কোয়েল পাখির ডিম, পাতিলে ভেজানো ছিল রান্নার চালও। এ দৃশ্য দেখে বোঝাই যাচ্ছিল রান্নার প্রস্তুতি চলছিল সকালে। কিন্তু ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল ফেলে সন্তানকে কোলে নিয়ে শুক্রবার সকাল ৯টা ১৬ মিনিটের দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যান সাথী আক্তার পারভীন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।
পুলিশের ধারণা, কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের ওই বাসায় প্রায়ই শিশু গৃহকর্মীকে (১০) নির্যাতন করা হতো। গত শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকালেও হয়ত ওই শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা হয়েছিল। শিশুটি মারা যাওয়ার পর রান্নার সব কিছু আর মোবাইল ফেলে লাপাত্তা হয়ে যান গৃহকর্ত্রী সাথী।
বিজ্ঞাপন
কলাবাগান থানা পুলিশের দাবি, শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাতে অজ্ঞাত ফোনে গৃহকর্মী মৃত্যুর প্রাথমিক তথ্য পায় কলাবাগান পুলিশ। এরপর রাত দেড়টার দিকে কলাবাগান থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৭৭ নং ভবনে গিয়ে বেশ কয়েকটি বাসায় খোঁজও নেয় পুলিশ। ওই ভবনটিতে ৪৪টি ফ্ল্যাট। মধ্যরাতে সব ফ্ল্যাটে খোঁজ নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় ফিরে আসে পুলিশ। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ির মালিক ও সোসাইটির লোকজন নিয়ে ভবনটির দ্বিতীয় তলার ই-১ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতর থেকে অজ্ঞাতনামা শিশু গৃহকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মৃত্যুর আনুমানিক ২৪ ঘণ্টা পর শনিবার (২৬ আগস্ট) সকালে মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহালে পুলিশ দেখতে পায়, শরীরে অনেক নতুন ও পুরাতন আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মুখে ফেনা, শরীর ফোলা। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন : বিড়ালের মালিকানা নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, বিচার গেল আইজিপির কাছে
এদিকে মৃত্যুর ৬০ ঘণ্টা ও মরদেহ উদ্ধারের প্রায় ৩২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও নিহত গৃহকর্মীর নাম, পরিচয়, ঠিকানা, বাবা-মার পরিচয় রোববার (২৭ আগস্ট) বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি কলাবাগান থানা পুলিশ। শুধু তাই নয়, লাপাত্তা হওয়া অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রীরও খোঁজ মেলেনি।
নিহতের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় হয়নি মামলাও
নিহতের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। পুলিশ বলছে, নিহতের পরিচয় শনাক্তে সব ধরনের চেষ্টা চলছে।
এ ব্যাপারে রোববার (২৭ আগস্ট) দুপুরে কলাবাগান থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবনের অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না অভিযুক্ত নারীর। ওই বাসায় যে গৃহকর্মী আছে তা অনেকে জানলেও দেখেছেন খুব কম। গৃহকর্মীর মৃত্যুর পর ওই নারীও লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা সব ধরনের চেষ্টা করছি। ওই নারীর গ্রামের বাড়ি পাবনা সদরে। আমরা সেখানকার লোকাল থানায়ও নিহতের সুরতহালকালীন তোলা ছবি পাঠিয়েছি। এখনো পরিচয় শনাক্ত হয়নি।
পরিচয় না মিললে আজই হবে মামলা
কলাবাগান থানার ওসি (তদন্ত) আবু জাফর মো. মাহফুজুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, নানাভাবেই পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। কিন্তু সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অভিযুক্ত নারীর নিকটাত্মীয় ও পরিচিতদের মাধ্যমে শুনেছি নিহত গৃহকর্মী এতিম। তবে সেটিও নিশ্চিত নয়। পরিচয় না মিললে আজই পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
কলাবাগান থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সেন্ট্রাল রোডের ৭৭ নং ভবনের দ্বিতীয় তলায় ফ্ল্যাট ই-১ এ বাসিন্দা সাথী আক্তার পারভীন তার শিশু সন্তান আর ওই গৃহকর্মী নিয়ে বসবাস করতেন। গত তিন বছর ধরে নিহত গৃহকর্মী ওই বাসায় কাজ করছিল।
আরও পড়ুন : রেড নোটিশেই আটকা ‘৬৫ অপরাধীর’ ফেরানো প্রক্রিয়া
ওসি সাইফুল বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি অভিযুক্ত সাথী আক্তার পারভীন দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্বামীর নাম মামুন। তিনি পেশায় গাড়ি চালক। তার ঘরে কন্যা সন্তান রয়েছে। তার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একজন চিকিৎসকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তার সঙ্গেও ডিভোর্স হয় ২০২০ সালে। ওই স্বামীর পরিচয়েই তিনি ফ্ল্যাটটিতে ২০১৬ সাল থেকে থাকেন। ডিভোর্সের পর সাথীর স্বামী ঢাকা থেকে চলে যান এবং তিনি এখন যশোরে থাকেন। সাথীর চিকিৎসক স্বামীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে জানতে পারি, ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে তিনি আর এ বাসায় আসেন না। তার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর ওই গৃহকর্মীকে বাসায় এনেছিলেন সাথী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকাল ৯টা ৪ মিনিটে নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যান সাথী আক্তার। এর ৫ মিনিট পর ৯টা ৯ মিনিটে আবারও ফিরে আসেন। পরবর্তীতে ৮ মিনিট পরে আবার বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ফেরেননি।
ডিএমপির কড়াকড়ি থাকলেও তিন বছরেও গৃহকর্মী তথ্য ফরম নেয়নি পুলিশ
ভাড়াটিয়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট থানায় না দিলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে বাড়ির মালিকদের। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে ভাড়াটিয়া ও বাড়ির কর্মচারীর তথ্যসংবলিত নির্ধারিত ফরম নিকটবর্তী থানায় জমা দিতে বলা হয়। এছাড়া বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগেই জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তথ্যসংবলিত ফরম সংগ্রহে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাকেও জবাবদিহি করতে হবে বলে জানায় ডিএমপি। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে বাসার কাজে বুয়া, গৃহকর্মী ও বাসার কেয়ারটেকার ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদেরও তথ্য সংগ্রহে রাখার নির্দেশনা দেয় ডিএমপি।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই নিহত গৃহকর্মীর ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম নেই পুলিশের কাছে। যদিও গত তিন বছর ধরে ওই বাসায় কাজ করছিল গৃহকর্মী। গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে ওই গৃহকর্মীর মৃত্যুর পর যে কারণে তার পরিচয় শনাক্তে বিপাকে পড়েছে পুলিশ।
আরও পড়ুন : আ.লীগের সংঘর্ষ চলাকালে রেজাউলের পায়ে কোপ দিল কারা?
এ ব্যাপারে কলাবাগান থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে ওই অভিযুক্ত নারীর কোনো তথ্য ছিল না। গৃহকর্মীসহ নিজের পরিবারের সদস্যদের তথ্য ফরম পূরণ করে জমা দেননি গৃহকর্ত্রী সাথী। এটা সংগ্রহ করা পুলিশের দায়িত্ব নয়, নাগরিক দায়িত্ব বটে। আজকে ওই গৃহকর্মীর তথ্য ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমে থাকলে পরিচয় শনাক্ত সহজ হতো।
কলাবাগান সেন্ট্রাল রোডের ওই বাসায় রোববার (২৭ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাসার দরজায় তালা ঝুলছে। ফ্ল্যাটের আশপাশের বাসিন্দাও এ ঘটনার পর থেকে নিশ্চুপ।
ভবনের সার্ভিস চার্জ ১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বকেয়া রেখেছেন সাথী
ভবনটির কেয়ারটেকার মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৬ সাল থেকে সাথী ও তার স্বামী ডাক্তার শহীদুল হক রাহাত এখানে বসবাস করতেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব হওয়ায় তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। নিজেকে এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিলেও আদতে তিনি কী করেন কেউ জানি না। সাথী আক্তার প্রভাব খাটিয়ে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন। আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন।
তিনি বলেন, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর থেকে (২০২০ সাল থেকে) তিনি বাসার কোনো সার্ভিস চার্জও পরিশোধ করেননি। এই ভবনের দায়িত্বে আসার আমার দুই বছর হলো। কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখতেন। কারো সঙ্গে মিশতেন না। সার্ভিস চার্জ ১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। চাইতে গেলে তিনি খারাপ আচরণ করেন। বলেন যা দেওয়ার স্বামী দেবে। ডিভোর্স নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মামলা চলছে বলে শুনেছি। একাধিকবার পুলিশের তথ্য ফরম পূরণের জন্য তাগাদা দেওয়া হলেও তিনি তা জমা দেননি।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু ভাড়াটিয়া বা বাড়ির মালিক নয় বাসার কেয়ারটেকার ও গৃহকর্মীর তথ্যও পুলিশকে জানাতে হবে এ নির্দেশনা আগেই দেওয়া ছিল। তবে করোনাকালীন সময়ে এই নির্দেশনা কিছু বিষয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে। সিডিএমএস( ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) এ তথ্য থাকলে সহজেই অপরাধী বা ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। কলাবাগানে নিহত গৃহকর্মীর পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে হয়ত পুলিশের কাছে ডাটা দেওয়া হয়নি, অথবা সংগ্রহে নেই। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে নতুন করে নির্দেশনার কিছু নেই, তবে তাগাদা দেওয়া হবে।
জেইউ/এসকেডি