নিহত কিশোর মো. নুর নবী /ছবি : সংগৃহীত

কী কারণে আদরের ছোট ছেলে নিখোঁজ হয়েছিল এখনো জানেন না রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ধলপুর বাদল সর্দারের গলি এলাকার বাসিন্দা মো. গোলাম রসুল। ১৪ বছর বয়সী ছেলে মো. নুর নবী অপহৃত হওয়ার পর ঘুরেছেন থানা পুলিশ ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) দুয়ারে দুয়ারে। কেউই ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ তার।

থানা পুলিশ একটি জিডি নিয়ে তাকে পরামর্শ দেয় র‍্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। র‍্যাবের কাছে যাওয়া হলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, তারা মামলা ছাড়া কোনো কাজ করতে পারবেন না। এরপর আবার থানায় যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মামলা নিতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এভাবে কেটে যায় চার দিন। 

এর মধ্যেই একাধিকবার অপহরণকারীদের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ সময়ে কয়েকবার তারা দাবি করে মুক্তিপণ। বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় মুক্তিপণের কিছু টাকা। প্রত্যেকটি বিষয়ে যথাসময়ে অবহিত করা হয়েছে পুলিশ এবং র‍্যাবকে। কিন্তু উদ্ধার করা যায়নি ভুক্তভোগী নুর নবীকে। একপর্যায়ে অপহরণকারীদের পাঠানো একটি ভিডিওর সূত্র ধরে নুর নবীর বড় ছেলে নিজেই চলে আসেন চট্টগ্রামে। সেখানে যাওয়ার পর ভাইকে তিনি পেয়েছেন। তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায় হাসপাতালের মর্গে। 

পুলিশ জানায়, শুক্রবার ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার হিলভিউ আবাসিক এলাকার ১০ নম্বর সড়কের পাশে একটি গ্যারেজের সামনে থেকে এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। পরে সেখানে নুর নবীর বড় ভাই রমজান হোসেন গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন। 

জানতে চাইলে রমজান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুর নবী নিখোঁজের পর আমার বাবার নম্বরে প্রথমে একটি অজ্ঞাতনামা নম্বর থেকে কল আসে। এরপর তারা আমাদের নুর নবী কোথায় আছে জানতে চাইলে ইমোতে যোগাযোগ করতে বলে। তাদের কথামতো ইমোতে যোগাযোগ করা হলে সেখানে একটি ছবি পাঠায় তারা। একই সঙ্গে তারা লেখে নুর নবী ভারতের সীমান্তে রয়েছে। এরপর আবার যোগাযোগ করে তারা ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ পাঠাতে বলে। পুলিশের পরামর্শে আমি তাদের টাকা পাঠানোর জন্য বিকাশ নম্বর দিতে বলি। তারা দেবে দেবে বলে কালক্ষেপণ করে একপর্যায়ে বিকাশ নম্বর দেয়। ওই নম্বরে আমরা ৫ হাজার টাকা পাঠাই।

তিনি বলেন, সবগুলো বিষয় আমরা পুলিশকে জানাই। তারা বলে কাজ করছি। এদিকে ২৪ আগস্ট অপহরণকারীরা আমার বাবার ইমোতে একটি ভিডিও পাঠায়। ভিডিও পাওয়ার পর আমরা ভালো করে দেখলাম, আমার ভাইকে যেখানে দেখানো হয়েছে সেখানে চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশন নামে একটা লেখা ছিল। বিষয়টি পুলিশকে জানানোর পর আমি নিজেই বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। শুক্রবার সকালে ষোলশহর রেলস্টেশনে পৌঁছে নুর নবীর খবরাখবর নিই এবং স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলি। তাকে ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে বলি আমার ভাইয়ের কোনো সন্ধান পেলে জানানোর জন্য। এরপর আমি সেখানে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর আমাকে স্টেশন মাস্টার ফোন দিয়ে বলে অজ্ঞাতনামা এক কিশোরের মরদেহ পাওয়া গেছে। তার পরামর্শে আমি পাঁচলাইশ থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে চমেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে ছোট ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুক্তভোগীর নুর নবীর বাবা মো. গোলাম রসুল পেশায় একজন বাবুর্চি। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলে রমজান যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি ওয়ার্কশপে চাকরি করেন। নুর নবী সবার ছোট। তবে বয়স ১৪ বছর হলেও সে এখনো প্রথম শ্রেণিতেই পড়ত।  

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. গোলাম রসুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২১ আগস্ট বিকেলে নুর নবী খেলাধুলার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। এরপর আর ফিরে আসেনি। প্রথম দিন নুর নবীর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, সে হোসেন ভাই নামে একজনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেছে। ঘটনার দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে পাওয়া যাওয়ায় পরদিন ২২ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করতে যাই। সেখানে আইডি কার্ড নিয়ে যাওয়ায় আমার জিডি করা হয়নি। পুলিশ আমাকে আইডি কার্ড নিয়ে পরে যেতে বলে এবং এসময়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ নিতে বলে। এরপর আমি রাস্তায় খুঁজতে খুঁজতে বাসায় চলে যাই। এদিন দুপুরে আমার মোবাইলে কল করে অপরপ্রান্ত থেকে একজনে বলেন ‘তোমার ছেলে কোথায় আছে জান? ইমোতে ফোন দাও।’ এরপর আমি নম্বর সেট করে ইমোতে ফোন দিই। বেশ কয়েকবার দেওয়ার পরও কল রিসিভ হয়নি। এরই মধ্যে অপরপ্রান্ত থেকে মেসেজ দেওয়া হয় ‘এতো ফোন দিচ্ছ কেন? আমি ফ্রি হয়ে ফোন দেব।’ এক ঘণ্টা পর আবার ফোন দিই। তখন সে মেসেজ দেয় 'দিচ্ছি'। বিকেলে আমি আবার থানার উদ্দেশ্যে বের হই এসময় আবার অপরপ্রান্ত থেকে মেসেজ আসে 'ইন্ডিয়া বর্ডার।' তখন আমি দৌড়ে থানায় যাই। 

তিনি বলেন, থানায় গিয়ে আমি জিডি লিখে অফিসারকে সব খুলে বললাম। তিনি ওসির সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি ওসিকে বললে তিনি সবকিছু শুনে আমাকে জিডি করিয়ে দিলেন। এরপর আমি বাড়িতে চলে আসলাম। ২২ আগস্ট রাতে হঠাৎ মেসেজ আসল ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে। এরপর সারারাত তারা একটা মেসেজ দেয় আমরা একটা দিই। রাতেই থানায় জিডি করার পর একটা সংস্থার লোকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। উনাকে সব মেসেজ দিয়েছি। ওই সংস্থার লোক পরদিন (২৩ আগস্ট) আমাকে জিডির তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) বিষয়টি জানাতে বলেন। তারপর আমরা আইওর সঙ্গে কথা বলি। তার সঙ্গে আমরা ধনিয়া কলেজ এলাকায় দেখা করি। ওই সময় ওসিও ছিলেন। তারা আমাকে অপহরণকারীকে জানাতে বলেন, টাকা সব রেডি আছে বিকাশ নম্বর পাঠাতে। পুলিশের পরামর্শে আমরা অপহরণকারীদের কাছ থেকে বিকাশ নম্বর চাই। তারা আমাদেরকে বিকাশ নম্বর পাঠাতে কালক্ষেপণ করে। 

তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমরা বাসায় চলে আসি। কিছুক্ষণ পর আমাকে আইও ফোন দিয়ে বলেন, আপনারা বিষয়টি র‍্যাব-১০ এ জানান। এরপর ধোলাইপাড় র‍্যাব কার্যালয়ে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা সব খুলে বলি। তারা আমাকে জানায়, ‘র‍্যাব জিডির কাজ করে না। আপনি যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে মামলা রেকর্ড করে আসেন।’ 

এ সময়ে র‍্যাব আমার নামটা এন্ট্রি করে রাখে এবং জিডির ফটোকপি নেয়। আমি বাড়িতে চলে আসলে অপহরণকারীরা আমাকে ফোন দিয়ে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। কিন্তু নম্বর দিচ্ছিল না। আমি পুনরায় র‍্যাব অফিসে গেলাম। তখন র‍্যাব আমাকে বলে ‘আপনার কাগজ নিয়ে যান, মামলা করে আসেন।’ এরপর আমরা যাত্রাবাড়ী থানায় এসে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করি মামলা করার জন্য। একপর্যায়ে আমরা ওসির সঙ্গে কথা বলি। ওসি বলেন, ‘আপনার কাজ চলছে, আমাদের টিম কাজ করছে।’ আমরা উনাকে মামলার কথা বললে ওসি বলেন, ‘আমি কীসের ভিত্তিতে মামলা করব? আল্লাহ আল্লাহ করেন। আর বিকাশ নম্বরটা নিতে পারেন কি না দেখেন।’ 

গোলাম রসুল বলেন, বুধবার (২৩ আগস্ট) রাতে আমাদের এক পরিচিত লোক বলেন তার র‍্যাবের এক লোকের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। আমরা ওই র‍্যাব কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে মোবাইলে সব তথ্য দিই। উনি এসব তথ্য র‍্যাবের কেরানীগঞ্জ অফিসে দেন। পরদিন বৃহস্পতিবার আমাকে কেরানীগঞ্জ র‍্যাব অফিস থেকে ফোন দেন। তারা আমাকে অফিসে যেতে বললে আমি দ্রুত যাই। সেখানে যাওয়ার পর ওই অফিসের কর্মকর্তারাও আমাকে বিকাশ নম্বর নিতে পরামর্শ দেন এবং কাজ চলছে বলে জানান। এরপর আমি কেরানীগঞ্জ র‍্যাব অফিস থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পৌঁছাতেই একটি ভিডিও আসে। সেখানে আমার ছেলেকে দেখি, চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনে হাঁটছে। এরপর আমরা তাকে অনুরোধ করলাম বিকাশ নম্বর দিতে। এসময়ে আমরা থানার আইওকে বিষয়টি জানাই। হঠাৎ দুপুরে আমাকে ওই পাশ থেকে একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে টাকা পাঠাতে বলে। এরপর ওই নম্বরে আমরা ৫ হাজার টাকা বিকাশ করি এবং পুলিশ ও র‍্যাবকে নম্বরটা দিই।

তিনি বলেন, টাকা পাঠানোর পর ইমোতে অপর প্রান্ত থেকে ৫ হাজার টাকা কেন পাঠিয়েছি জানতে চায়। এসময় আমরা তাকে যে নম্বর দিছে সেটিতে ৫ হাজারের বেশি পাঠানো যাচ্ছে না জানিয়ে আরেকটি নম্বর দিতে বলি। তারা আমাকে আমাকে বেশি চালাকি করতে মানা করে এবং বিকাশের নম্বরে ফোন দিতে মানা করে ইমোতে ব্লক করে দেয়। একপর্যায়ে চট্টগ্রামে আমার ছেলের মরদেহ পাওয়া যায়। শুক্রবার সকালে ঢাকায় আমার ছেলের দাফন করা হয়েছে।

কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা আছে কি না জানতে চাইলে গোলাম রসুল বলেন, না আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমার এতো বড় সর্বনাশ কে করল জানি না।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অজ্ঞাতনামা এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধারের পর পরিবারের লোকজন এসে তাকে শনাক্ত করেছেন। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যতটুকু জেনেছি, ছেলেটি খেলার জন্য বেরিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছিল। এরপর মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. মফিজুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেটি নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা তাকে উদ্ধারে কাজ করছিলাম। একপর্যায়ে চট্টগ্রামে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

এমআর/এসকেডি