তিন বন্ধু থেকেও ব্রিকসে ডাক পেল না বাংলাদেশ!
বিকাশমান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসের নতুন সদস্য কে হতে যাচ্ছে তা নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল। ব্রিকসের নতুন সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বেশ আশাবাদী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সব ছাপিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে জোটটিতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ পেয়েছে ছয়টি দেশ। যেখানে ঠাঁই হয়নি বাংলাদেশের। এই জোটে ‘তিন বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত, চীন ও রাশিয়া থাকার পরও সদস্যপদ পায়নি বাংলাদেশ।
ব্রিকসে বাংলাদেশের নাম না আসার চেয়েও অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। কেননা জোটটিতে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ঠাঁই পায়নি কোনো দেশ। অথচ ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশ। এছাড়া লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকা থেকে একটি করে দেশ ব্রিকসে ঠাঁই পেয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ দেখিয়েছিল ৪০টিরও বেশি দেশ। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের আবেদন করেছিল ২৩টি দেশ। চলতি বছরের জুন মাসে ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে বাংলাদেশ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রিকসের আমন্ত্রণে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে কোনো দেশের নাম না থাকার বিষয়টি বিস্ময়ের। বিশেষ করে প্রভাবশালী অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিকসে ইন্দোনেশিয়াকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। বাংলাদেশের না থাকার নানান কারণ থাকতে পারে। আসলে আবেদন ছাড়া কিছুই করেনি বাংলাদেশ। এসব ক্ষেত্রে অনেক নেগোসিয়েশনে যেতে হয়, চিঠি চালাচালি বা কূটনৈতিক চ্যানেলে চেষ্টা করতে হয়। আর দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে কোনো দেশের না থাকার পেছনে হয়ত ভারত ও চীনের আন্তরিকতার অভাব ছিল।
ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, ব্রিকসের পক্ষ থেকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে একটি দেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বাংলাদেশও আমন্ত্রণ পেল না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, কে কবে আবেদন করল; আগে-পরে হলো কি না। ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক চালও থাকতে পারে। চীন ও ভারতের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। চীন হয়ত চেয়েছে এ জোটে ইরান ও সৌদি আরব থাকুক। এখান থেকে একটি দেশকে বাদ দিলে আরেকটি দেশ হয়ত বেঁকে বসতে পারে। ইন্দোনেশিয়া কেন বাদ গেল, সেটিও বড় প্রশ্ন হতে পারে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াকে তালিকায় না রেখে ইথিওপিয়াকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হলো, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ব্রিকসে ডাক পাওয়া নিয়ে এ কূটনীতিক বলেন, পরবর্তী সময়ে কবে নাগাদ হয়, সেটি নিয়ে আবার দীর্ঘসূত্রিতা হয় কি না! ব্রিকসের সদস্যপদ কয় বছর পর পাওয়া যেতে পারে, তা নিয়েও কোনো ধারণা করার সুযোগ নেই।
ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ দেখিয়েছিল ৪০টিরও বেশি দেশ। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের আবেদন করেছিল ২৩টি দেশ। চলতি বছরের জুন মাসে ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে বাংলাদেশ। একই মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর বিষয়টি সামনে আনেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সে সময়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, আগস্টে ব্রিকসের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে বাংলাদেশ।
এরপর থেকে গত মাস চারেক ধরে ব্রিকসে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সপ্তাহখানেক আগে জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ দেওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যে জোটটিতে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া নিয়ে আশার বাণী শোনান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। গত জুন মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট তখন বলেছিলেন যে, তারা ব্রিকসে নতুন চারটি দেশকে নিতে চান। আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোন কোন দেশ? তখন তিনি জানিয়েছিলেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ।
অবশ্য ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর যোগ দিতে যাওয়ার আগের দিন একটু ভিন্ন পথেই হাঁটেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ব্রিকসে যোগ দেওয়া নিয়ে আমাদের তাড়া নেই।
ব্রিকসে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিকসের কৌশলগত গুরুত্বের মধ্যে পড়ে না বাংলাদেশ। তবে চীন ও ভারত চাইলে বাংলাদেশকে যুক্ত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বন্ধুপ্রতিম ভারত ও উন্নয়ন সহযোগী চীনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে কোনো দেশকে জোটটিতে যুক্ত হতে আমন্ত্রণ না জানানোর একটি কারণ থাকতে পারে। আর তা হলো এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতিক নীতি। কেননা পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিকল্প একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করা ব্রিকসে এমন ধরনের দেশকে যুক্ত করতে চাইছে না জোটটি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রাজিল চেয়েছে ব্রিকসে আর্জেন্টিনা যুক্ত হোক। আর এর মাধ্যমে জোটটিতে দক্ষিণ আমেরিকার প্রভাব বাড়ুক। সৌদি আরব ও আমিরাত ধনী দেশ। তাদের সঙ্গে তেল কূটনীতির ব্যাপার রয়েছে। সে কারণে ব্রিকসে যোগ দিতে তাদের আহ্বান জানানো হয়েছে হয়ত। এছাড়া আমেরিকাবিরোধী দেশ হিসেবে ইরান সেখানে গুরুত্ব পাবে। এ জোটে রাশিয়া ইরানকে চায়, চীনও চেয়েছে। তবে বাংলাদেশ এখনও কৌশলগত গুরুত্বের মধ্যে পড়ে না। তবুও আমাদের যুক্ত করতে হলে চীন ও ভারতকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হতো। হয়ত তারা করেনি। চীন মনে করে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আছে। আবার ভারত মনে করে, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আছে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইন্দোনেশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল। তাদের আমন্ত্রণ না পাওয়া অবাক হওয়ার বিষয়। ইন্দোনেশিয়া কৌশলগতভাবে সম্ভাবনাময় শক্তি, কিন্তু কেন দেশটিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তা বুঝতে পারছি না। হয়ত চীন ও ভারত তাদের ব্যাপারে কমফোর্টেবল নয়। সব কিছুতেই রাজনীতি রয়েছে। এক্ষেত্রে ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন চাল চালা হয়েছে।
ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দক্ষিণ আফ্রিকা যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন দিনব্যাপী ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) ছয়টি দেশকে জোটটির পূর্ণ সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জানান, নতুন দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমন হতে পারে যে, এসব অঞ্চলের দেশগুলো কোন পক্ষের দিকে যাবে; যেসব দেশ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি তাদের নেওয়া হয়নি। ব্রিকসের নেতারা হয়ত ভাবছেন এ ধরনের সদস্য নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। ব্রিকসে যুক্ত হওয়া নতুন যে দেশগুলোর নাম দেখছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন যে মেরুকরণের চেষ্টা চলছে, এ দেশগুলো কিন্তু একটা বলয়ের মধ্যে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো ইরান।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে হয়ত এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে যে, এসব দেশ কোন পক্ষের দিকে যাবে। না কি এসব দেশ দুই বলয়ের মাঝে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। সেটি কিন্তু এখনও নিশ্চিত নয়। যার ফলে, আমার মনে হচ্ছে, ব্রিকস হয়ত ভাবছে এটা তাদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। হয়ত সে ভাবনা থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০২১ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে পরিচিত ব্রিকসের ব্যাংকে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। প্রায় আড়াই বছর আগে অনেকটা ভারতের আমন্ত্রণে ব্রিকস ব্যাংকে যুক্ত হতে রাজি হয় বাংলাদেশ। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ভাচুর্য়াল সামিটে বাংলাদেশকে ব্রিকস ব্যাংকে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে ভারত পাশে ছিল না বলে গণমাধ্যমে খবর চাউর হয়। কেননা, ব্রিকসে বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়ে উদ্যোগী হয় চীন। বিষয়টি হয়ত ভালোভাবে নিতে পারেনি নয়া দিল্লি। ধারণা করা হচ্ছে, বেইজিং ও নয়া দিল্লির দ্বন্দ্বের বিষয়টি হয়ত ব্রিকসে যুক্ত হতে বাংলাদেশের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এনআই/কেএ