আবারও মুখোমুখি জীবন-জীবিকা
করোনার মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় লকডাউনের পথে হাঁটে সরকার। শনিবার (৩ এপ্রিল) সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আগামী ৫ এপ্রিল, সোমবার থেকে সাতদিনের জন্য লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারে।’ সন্ধ্যায় এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। এছাড়া লকডাউনের ব্যাপ্তি কী হবে, কী কী খোলা থাকবে আর কী কী বন্ধ থাকবে— সে বিষয়েও বিস্তারিত জানানো হবে।
এদিকে, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিও বার্তায় লাকডাউন প্রসঙ্গে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের স্বার্থে সরকার দু-তিনদিনের মধ্যে সারা দেশে এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে।’
বিজ্ঞাপন
লকডাউনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অধিদফতরের পক্ষ থেকে ১২ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার বলেছে প্রথম এক সপ্তাহ হবে। পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, লকডাউনকালে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এছাড়া গণপরিবহন, দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, বিমান ও ট্রেন চলবে কি না, সে বিষয়ে রাতেই (শনিবার) নির্দেশনা তৈরি হবে, যা রোববার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হতে পারে। লকডাউন চললে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সের ছুটি আপাতত স্থগিত থাকবে বলেও জানান তিনি।
যদিও সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগেই লঞ্চ, ট্রেন ও অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। রাজধানীর আরামবাগের একটি প্রিন্টিং কারাখানায় চাকরি করেন খায়রুল আলম। তিনি বলেন, দুই মাস আগে ঢাকায় এসে এখানে কাজ নেই। সামনে রমজান ও ঈদ। কিছু টাকা উপার্জন করে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে ঈদ করব, ভেবেছিলাম। এখন কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কীভাবে সংসার চালাব?
সরকার লকডাউন না দিয়ে বিকল্প উপায়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারত। তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সুবিধা হতো। এখন লকডাউন দিলে কীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচব? কোনোকিছুই ভেবে পাচ্ছি না— বলেন খায়রুল আলম।
কথা হয় পলওয়েল মার্কেটের ব্যবসায়ী জয়ের সঙ্গে। বলেন, ‘গত বছর রমজানের ঈদের আগে একটি দোকান থেকে ৪০ লাখ টাকা লোকসান হয়। বছর পার না হতেই আবার লকডাউন! তাও ঈদের আগে। এভাবে লকডাউন হলে পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার ক্ষতি পোষাতে আরামবাগে আরেকটা ছোট ব্যবসা চালু করি। এখন দুটি ব্যবসা নিয়ে খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। সরকারের উচিত রমজানের আগে লকডাউন শেষ করা।’
মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন খালিদ হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘দুপুরে লকডাউনের খবর শোনার পরই মাথা নষ্ট। গতবার লকডাউনের কারণে বেতন-ভাতা পাইনি। এবারও যদি লকডাউন হয় কীভাবে পরিবার নিয়ে চলব? সরকারের উচিত সীমিত পরিসরে লকডাউন দিয়ে রমজানের আগে সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া। তা না হলে পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে যাবে।’
লকডাউনের বিষয়ে রিকশাচালক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘লকডাউন দিলে তো আমাদের কিছুই করার থাকবে না। তবে সরকারের উচিত আমাদের মতো দিনমজুরের কথা চিন্তা করে অন্যভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। সবার ভালোর জন্য যদি লকডাউন দেওয়া হয় রোজার আগে তা শেষ করা উচিত। তা না হলে বাড়িতে ছেলে-মেয়ে না খেয়ে থাকবে।’
‘সরকারের উচিত ছিল ১৫ দিন আগেই লকডাউন দেওয়া। করোনার পরিস্থিতি তো এখন বাড়েনি, অনেক আগেই এটা বাড়তির দিকে। তখন দিলে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকত। সামনে রমজান ও ঈদ। করোনার পরিস্থিতি থেকেও ভয়াবহ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে না খেয়ে থাকা’— মন্তব্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিমুল রহমানের।
আতঙ্কে রাইড শেয়ারিং চালকরা
এদিকে, লকডাউনের খবরে জীবিকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকরা। তারা বলছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে গত ৩১ মার্চ সরকার ১৮টি নতুন নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনার পরপরই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করে দেয় দুই সপ্তাহের জন্য। রাইড শেয়ারিং বন্ধ করে দিলেও খ্যাপ (যাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে) মারতেন তারা। এতে ট্রাফিক পুলিশ বাধা দিলেও কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু এখন লকডাউন ঘোষণার পর এ ব্যবস্থাও বন্ধ হওয়ার পথে। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
তবুও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই
সারাদেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রাণহানি ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ১৮ দফা নির্দেশনা। এতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা থাকলেও রাজধানীর অনেক এলাকায় তা উপেক্ষিত হচ্ছে। হাট-বাজার, মার্কেট ও শপিংমলে যেন স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অনেকে মাস্ক ব্যবহার করছেন না। সামাজিক দূরত্ব, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা নিশ্চিত করা যায়নি। গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকলেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে।
শনিবার (৩ এপ্রিল) সরেজমিনে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম। কিছু সময় পরপর মাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু তোয়াক্কা করছেন না কেউ। অনেকের মাস্ক নেমে এসেছে থুতনির নিচে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন না কেউই।
নিউ মার্কেটর কাঁচা বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকের মুখে মাস্ক থাকলেও বিক্রেতাদের মুখে ছিল না মাস্ক। মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সবজিবিক্রেতা শাহিন আলম বলেন, মাস্ক পরে গরমের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। ক্রেতাদের সঙ্গে সবজির দরদাম করতে হয়। বাধ্য হয়ে মাস্ক খুলে বসতে হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং মুখে মাস্ক রেখে বাজারে অবস্থান করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। না মানলে সেই দায়ভার তার ব্যক্তিগত।
লকডাউন ঘোষণায় ভিড় বাড়ছে বাজারে
করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আবারও ‘লকডাউনের’ ঘোষণা আসছে— এমন খবরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানগুলোতে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। অনেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাড়ি ফিরছেন। শনিবার (৩ এপ্রিল) বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরার ৩নং সেক্টরের রাজলক্ষ্মী, ৫নং সেক্টরের জোহরা মার্কেটসহ আশপাশের বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। দোকানিরা জানান, বিকেল ৩টার পর থেকে দোকানে ক্রেতা সমাগম বাড়তে শুরু করে। অনেকেই ১০ থেকে ১৫ দিনের বাজার একবারে সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছেন। এসব বাজারে সাধারণত দুপুর ১টার পরে ভিড় দেখা যায় না। তবে আজ লকডাউন আসছে— এমন খবরে দুপুরের পর থেকে ক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়েছে। সময় যত যাচ্ছে ক্রেতারা তত ভিড় জমাচ্ছেন।
জোহরা মার্কেটের দোকানি হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুপুরের পর থেকে বাজারে সাধারণত ক্রেতাদের উপস্থিতি কম থাকে। আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ক্রেতা দেখা যাচ্ছে। সামনে রোজা ও লকডাউন— এ দুই কারণে হয়তো ক্রেতারা একবারে বেশি পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
১৪নং সেক্টরের তসলিম আহমেদ জানান, আসলে গত কয়েকদিন ধরে যে হারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তাতে সবাই লকডাউনের অনুমান করেছিল। এখন দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় একসঙ্গে বাজার করতে হচ্ছে।
কাঁঠাল বাগান বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সামনে রমজান মাস তাই আগে থেকে বাজার করার পরিকল্পনা ছিল। ভেবেছিলাম আরও কয়েকদিন পর করব। আজ হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণার পর দ্রুত বাজারে আসতে হলো। লকডাউনের কারণে যদি দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারব না।
এদিন রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের মিনি মার্কেট, নূরানী মিনি মার্কেট, গাউসিয়া, ইসমাইল ম্যানসন, এয়াকুব সুপার মার্কেট, সুভাস্তু অ্যারোমা সেন্টার, চন্দ্রিমা ও নিউ মার্কেট ওভারব্রিজ ঘুরে মানুষর উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিটি মার্কেটের গেটে ও দোকানগুলোয় ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ছিল ফুটপাথে। সেখানে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে পণ্যে কিনছিলেন ক্রেতারা।
নিউ মার্কেট ওভারব্রিজে আজিমুল নামে মাথার ক্লিপ-ব্যান্ড বিক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ রাস্তা ও মার্কেটগুলোতে প্রতিদিনই ভিড় হয়। তবে শুক্রবারে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে। আজ শুক্রবারের চেয়েও বেশি ভিড়। জাহানারা বেগম নামের এক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সংক্রমণ না কমলে লকডাউন হয়তো রমজান ও ঈদ পর্যন্ত যেতে পারে ৷ তাই আগেভাগেই কেনাকাটা সারতে এসেছি।
এদিকে ফার্মেসি ও বিভিন্ন দোকানে বেড়েছে হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা। শুক্রাবাদ কাঁচাবাজারের মুদি দোকানদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে লাইফবয়, স্যাভলন ও ডেটল হ্যান্ডওয়াশের রিফিল প্যাক শেষ হয়ে গেছে। ক্রেতা আসছেন কিন্তু দোকানে মজুত না থাকায় দিতে পারছি না।
বেড়েছে মাস্কের চাহিদাও। লকডাউন ঘোষণার পর ফুটপাত থেকে মার্কেট সব জায়গায়ই মাস্ক কিনতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। এ সুযোগে বেশি দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। সকালে পাঁচটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০টাকায় বিক্রি হলেও এখন একটি মাস্কের দাম চাওয়া হচ্ছে ১০টাকা।
এদিকে ফার্মেসি ও বিভিন্ন দোকানে বেড়েছে হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা। শুক্রাবাদ কাঁচাবাজারের মুদি দোকানদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে লাইফবয়, স্যাভলন ও ডেটল হ্যান্ডওয়াশের রিফিল প্যাক শেষ হয়ে গেছে। ক্রেতা আসছেন কিন্তু দোকানে মজুত না থাকায় দিতে পারছি না।
বেড়েছে মাস্কের চাহিদাও। লকডাউন ঘোষণার পর ফুটপাত থেকে মার্কেট সব জায়গায়ই মাস্ক কিনতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। এ সুযোগে বেশি দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। সকালে পাঁচটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০টাকায় বিক্রি হলেও এখন একটি মাস্কের দাম চাওয়া হচ্ছে ১০টাকা।
লকডাউনে কী খোলা ও বন্ধ থাকছে
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন শনিবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার, ওষুধ ও খাবারের দোকানের পাশাপাশি পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পকারখানা লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে।
তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি লকডাউনে মানুষের চলাচল যতটা সম্ভব বন্ধ করার। কারণ, যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে মানুষের ঘরে থাকা জরুরি। তবে জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। এছাড়া পোশাক ও শিল্পকারখানাগুলো খোলা থাকবে। কারণ, কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকদের বাড়িতে ফেরার তাড়া থাকে। এতে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়ে। কারখানায় শ্রমিকদের একাধিক শিফটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে বলা হবে।
বন্ধ থাকছে অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট
লকডাউন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ সব রুটের ফ্লাইট বন্ধ থাকছে। শনিবার (৩ এপ্রিল) ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সোহেল। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের সময় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি লকডাউন চলাকালীন অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকবে। সরকার যেদিন থেকে লকডাউন কার্যকর করবে সেদিন থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলও বন্ধ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় আগামী সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে লকডাউন দিচ্ছে সরকার। লকডাউনে মালবাহী ছাড়া যাত্রীবাহী সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
শনিবার বিআইডব্লিউটিএ'র চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে সোমবার সকাল ৬টা থেকে সারা দেশের সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান বন্ধ থাকবে। তবে মালবাহী জাহাজ চলাচল করবে।
লকডাউনে বন্ধ থাকছে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল
লকডাউনে জরুরি খাদ্য ও পণ্যবাহী ট্রেন ছাড়া সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে শিগগিরই।
বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, লকডাউন শুরু হবে সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে। লকডাউনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি খাদ্য ও পণ্য পরিবহন করা হবে।
বন্ধ থাকবে দোকানপাট-শপিংমল
লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ থাকছে। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুর রহমান টিপু এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনের বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমাদের মানতেই হবে। কারণ দেশের করোনা পরিস্থিতি এখন ভালো না। তাই আগামী ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ থাকবে। তবে আমাদের দাবি এই লকডাউন এক সপ্তাহের বেশি যেন না বাড়ে।
তিনি আরও বলেন, এর আগে সরকারের নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা শপিংমল ও দোকানের ব্যবসা পরিচালনা করেছি। নতুন করে যদি এর সঙ্গে কিছু যোগ করে তাও আমরা মানতে রাজি। তবে ঘোষিত লকডাউনের সময় যেন আর না বাড়ে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। কারণ এক সপ্তাহ পর সময় বাড়ালে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
এ বিষয়ে বসুন্ধরা সিটি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (অ্যাকাউন্ট) শেখ আব্দুল আলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনের ঘোষণা এসেছে, তবে এখন পর্যন্ত পুরো নির্দেশনা পাইনি। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে সেভাবেই আমরা চলব। শপিংমল এক সপ্তাহ বন্ধ রাখতে বললে আমরা বন্ধ রাখব।
করোনায় আরও ৫৮ জনের মৃত্যু
করোনার সংক্রমণ রোধে সারাদেশে লকডাউনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে সরকার। এমন সিদ্ধান্তের দিনে খবর এলো করোনায় আরও ৫৮ জনের মৃত্যুর। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল নয় হাজার ২১৩ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৮৩ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ছয় লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জনে।শনিবার (৩ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৩৬৪ জন। এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৫ জন।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
গত বছরের শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জারি করা হয় লকডাউন। এতে থমকে যায় দেশগুলোর অর্থনীতির চাকা। বাংলাদেশেও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে জেলাভিত্তিক চলাচল সীমিত করা হয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে বিভিন্ন দেশ শর্তসাপেক্ষে লকডাউন তুলে নেয়। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রতিষেধক টিকার প্রয়োগ শুরু হয়। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হচ্ছে।
লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারি নির্দেশনা পেলেই ব্যবস্থা : ডিএমপি
করোনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা রাজধানী ঢাকায় লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই কার্যকরে মাঠে নামবে ডিএমপি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) কৃষ্ণ পদ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের হাতে এখনও প্রজ্ঞাপন পৌঁছায়নি। প্রজ্ঞাপনে অনেকগুলো নির্দেশনা চলে আসবে। কার কী দায়িত্ব থাকলো সে অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নেব।
এছাড়া আর কোনো উপায় নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কারণ সংক্রমণ দিনদিন বাড়ছে। লকডাউনের পরিস্থিতির জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।
টিএইচ/এমএআর/