★ উন্নত জীবন, ভালো চাকরির প্রলোভনে মানবপাচার
★ মানবাপাচারের রুট নারায়ণগঞ্জ-টেকনাফ-মিয়ানমার-মালয়েশিয়া
★ মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্রে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার
★ মুক্তিপণ না দিলে চলে অমানবিক নির্যাতন

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মা সাইন প্রিন্টিং প্রেসে বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কাজ করতেন জহিরুল ইসলাম (৩৮)। এ বছরের মার্চ মাসে দোকানের পাশ থেকে নিখোঁজ হন তিনি। এক মাস পর পরিবার জানতে পারে জহিরুল মিয়ানমারে বন্দি। মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় ছয় লাখ টাকা।

হতবিহ্বল পরিবার অনেক কষ্টে চার লাখ ২০ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকের একটি একাউন্টে পাঠায়। এরপর বিকাশে আরও টাকা পাঠায়। নগদ টাকা নিতে এসে এপ্রিল মাসে চক্রের এক সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আড়াইহাজার থানায় মামলা করেন জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। এই খবরে জহিরুলের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। জানানো হয়, জহিরুল আর জীবিত ফিরবেন না।

পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, শুধু জহিরুল নয়, মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা থেকে মোট ১৯ জন যুবককে মিয়ানমারে আটকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সেখানে বন্দিদশায় নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে জহিরুল মালয়েশিয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। 

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মো. ইসমাইলকে (৪৫) তার দুই সহযোগীসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

গ্রেপ্তার হওয়া ইসমাইলের ২ সহযোগী হলেন মো. জসিম (৩৫) ও মো. এলাহী (৫০)। 

গ্রেপ্তার তিন মানবপাচারকারী। ছবি- সংগৃহীত

শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ফোর্সের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ড কর্তৃক আটক হয়। এ ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল আবুল কামলাম আজাদ বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। 

পরবর্তীতে অন্যান্য ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন করেন। 

চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়। র‌্যাব এ মানবপাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে এবং মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

রোহিঙ্গা নাগরিকদের সহযোগিতায় মানবপাচারের চক্র গড়েন ইসমাইল
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ইসমাইল ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় অবস্থান করেন। সেখানে মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে ওঠে। 

পরবর্তীতে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল এবং জামালের সঙ্গে যোগসাজশে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলেন এবং স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে অবৈধভাবে মানব পাচার কার্যক্রম শুরু করেন।

তিনি প্রায় ১০-১২ বছর ধরে মানবপাচারের এই চক্রটি পরিচালনা করছেন বলে জানা যায়। ইসমাইল নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে এই চক্রের দেশে এবং বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধভাবে মানবপাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে এবং ইতোপূর্বে তিনি কারাভোগও করেছেন।

ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ পাঠিয়ে উন্নত জীবন গড়ার প্রলোভন
কমান্ডার মঈন জানান, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদের কোনো প্রকার অর্থ, পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাত। ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার টাকা করে এবং চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার টাকা করে রেখে বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের কাছে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো।

মানবপাচারের রুট। ছবি- সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে টেকনাফ, সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার-মালয়েশিয়া
ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় যে তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করত তাদের জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা মূলহোতা ইসমাইলের কাছে নিয়ে যেত। তারপর তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করত। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারযোগে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দিতো। 

মিয়ানমারে গোপন ক্যাম্পে জিম্মি করে নির্যাতন, মুক্তিপণ দাবি
মিয়ানমারে জামাল তার গোপন ক্যাম্পে ভুক্তভোগীদের রেখে নির্যাতন করতেন। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা মূলহোতা ইসমাইলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতেন। 

মুক্তিপণ না দিলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে পুনরায় নির্যাতন করা হতো এবং যেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা প্রদান করে তাদেরকে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের নিকট পাঠিয়ে দিতো। 

ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে বাকি টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতেন। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মিয়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপনের টাকা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো।

র‌্যাবের কমান্ডার মঈন বলেন, রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ বছর ধরে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটি চলতি বছরের ১৯ মার্চ মোট ২২ জনকে ট্রলারযোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করার সময় মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছালে দেশটির কোস্টাগার্ড ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে।

বাকি ৩ জনকে এই চক্রের সদস্য মিয়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করে। তাদের মধ্যে ছিল জহিরুলও। তার পরিবারের কাছে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রের সদস্যরা। জহিরুলের পরিবার ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ প্রদান করে। বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর প্রদান করবে বলে জানায়।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয় জহিরুলকে। নির্যাতনের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। 

মানবপাচারকারী চক্রের নির্যাতনে নিহত জহিরুল। ছবি- সংগৃহীত

গ্রেপ্তার জসিম ও এলাহীর বিষয়ে র‌্যাব জানায়, দুজন চক্রটির অন্যতম সহযোগী। তারা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশ গমনে প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করে গ্রেপ্তার ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসতো। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।

মানবপাচারকারী চক্রের নির্যাতনে নিহত ভুক্তভোগী জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। মা সাইন প্রিন্টিং প্রেসে আমার সঙ্গেই কাজ করত জহিরুল। হঠাৎ একদিন দোকানের পাশ থেকে জহিরুলকে মেরে উঠিয়ে নিয়ে যায় মানবপাচারকারীরা।

ভুক্তভোগী জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। ছবি- ঢাকা পোস্ট

উন্নত জীবনের আশায় আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়
আজাদ বলেন, এ কোন উন্নত জীবন! ভিসা পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ যাওয়া যায় না। আমার ভাইটা বিবাহিত। ওর দেড় বছরের ছেলে ও সাত বছর বয়সী ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। 

মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে পুরো পরিবার আজ পথে বসার দশা। উন্নত জীবনের বদলে ভাইটাকে আমার মরতে হলো। এমন জীবন চাই না। দোয়া করি, আর কোনো পরিবারের কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়।

মানবপাচারে জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

জেইউ/এমএসএ