বর্ষা মৌসুম মানেই জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতায় নাকানিচুবানি খাবেন না, এটা তো হবে না। গত কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। জলজটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অথচ প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। বছর বছর অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষ ভোগান্তির পরিমাণও বাড়ে।

একসময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। পরে রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা গত ১২ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও এটি যেন নগরবাসীর পিছু ছাড়ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর জলাবদ্ধতা কমাতে বিভিন্ন সময় নানা প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। এ কাজে ব্যয়ও করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু এর সুফল পায়নি নগরবাসী। ঢাকা ওয়াসা ছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা জেলা প্রশাসন নিয়মিত অর্থব্যয় করে গেছে। পরে ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার খাল ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব বুঝে নেয় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।

চলতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীতে যে কয়েক দিন একটু বেশি বৃষ্টি হয়েছে, প্রতিবারই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। কোথায় হাঁটু পানি, কোনো কোনো সড়কে  তীব্র ঢেউও দেখা গেছে। এখন সাধারণ নগরবাসীর মনে প্রশ্ন, জলাবদ্ধতা নিরসনে এত প্রকল্প, এত উদ্যোগ, এত ব্যয়; আদৌ কি সুফল বয়ে এনেছে?

ঢাকা মহানগরীর প্রধান প্রধান ড্রেন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীন এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত। কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দায়িত্ব ছাড়ার আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এ প্রকল্পে রাজধানীবাসী কোনো সুফল পাননি। দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে গত ১০ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যয় করেছে প্রায় দুই হাজার ২৫ কোটি টাকা।

ঢাকা ওয়াসা ছাড়াও ড্রেনেজ খাতের উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরের আড়াই বছরে অর্থাৎ গত অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। ফলে এভাবে নানা সময় ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে কিন্তু নগরবাসী কোনো সুফল পাননি।

জলাবদ্ধতা নিরসনে আর কত ব্যয় করবে দুই সিটি কর্পোরেশন

জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ রেখেছে পাঁচ কোটি টাকা, ড্রেন ক্লিনিং খাতে রাখা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা, খাল পরিষ্কারেও সংস্থাটি ব্যয় করবে পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া পাম্প হাউসের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৯০ কোটি টাকা। এছাড়া ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ নামের প্রকল্পে ব্যয় ধরেছে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব কাজ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন

প্রতি বছর জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। এর মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- খালগুলো অবৈধ দখল, পানিপ্রবাহ ঠিক না থাকা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পরিকল্পনা না থাকা। এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ওয়াসার কাছ থেকে খাল ও ড্রেনের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমরা বর্জ্য অপসরণ, সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্তের কাজ শুরু করি। বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা হতে ২০২১ সালে আট লাখ ২২ হাজার টন, ২০২২ সালে চার লাখ ৪৪ হাজার টন এবং ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত দুই লাখ ৩৫ হাজার টান বর্জ্য ও পলি অপসারণ করি।

জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নকাজের জন্য চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে ১০৩টি স্থানের কাজ চলমান। এছাড়া ডিএসসিসির আওতাধীন শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর- এ চারটি খালের নকশা, অঙ্কন ও জরিপকাজ চলমান রয়েছে।

অন্যদিকে, উত্তর সিটি এলাকায় মোট ১০৩টি স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পরিবেশ আছে—এমন স্থান চিহ্নিত করেছে ডিএনসিসি। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোথাও জলাবদ্ধতা হলে ডিএনসিসির কুইক রেসপন্স টিম এবার কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে।

ডিএনসিসি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ এয়ারপোর্ট রোড এবং বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ ও পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, আব্দুল্লাহপুর খিজির খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে দাবি উত্তর সিটির।

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসি এলাকার খালগুলো অবৈধ দখল হতে উদ্ধার করে উন্নয়ন করা হচ্ছে। জিআইএস পদ্ধতিতে খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ চলমান। খালগুলোর পাশ দিয়ে ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেন নির্মাণ করা হবে। আমাদের খালগুলোর উন্নয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও বৃক্ষরোপণের জন্য ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দাবি, তারা খাল দখলমুক্তের কাজ করছে। ইতোমধ্যে ইব্রাহিমপুর, লাউতলা, কল্যাণপুর, রূপনগর, আব্দুল্লাহপুর, সিভিল এভিয়েশন, বাইশটেক ও বাউনিয়া খাল দখলমুক্তের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে এবার অনেকাংশেই জলাবদ্ধতা কম হচ্ছে।

রাজধানীর জলাবদ্ধতার বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য় নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। ওয়াসা ড্রেন ও খালগুলোর দায়িত্বে ছিল, এখন এটা সিটি কর্পোরেশনের আওতায়। সবসময় এগুলোর সমাধান না করে এক-অপরকে দোষারোপ করা হয়েছে। কিন্তু এখন কাজগুলো সিটি কর্পোরেশনকেই করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা।

‘সবমিলিয়ে শুধু প্রকল্প নিলেই হবে না, রাজধানীর জলাবদ্ধতা যেন না হয় সে কারণে পানি কোন দিক দিয়ে নামবে সেই কাজ আগে করে নিতে হবে। এজন্য নিয়ম মেনে সঠিক কার্যক্রম হিসেবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

এএসএস/এসকেডি