সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে’ নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে আরও একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। 

নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা মৌলভীবাজারের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা নিচ্ছিল সংগঠনটি।

শনিবার (১২ আগস্ট) মৌলভীবাজারে কুলাউড়া থানার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে নতুন জঙ্গি সংগঠনের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। 

সকাল ৭টার দিকে সিটিটিসির সোয়াট টিমের সদস্যরা বাড়িটিতে অভিযান শুরু করে। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন হিলসাইড’।

আরও পড়ুন>>> কুলাউড়ার জঙ্গি আস্তানা থেকে ১৩ জন আটক 

অভিযানে অংশ নেওয়া সিটিটিসির একাধিক কর্মকতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই সংগঠনটির মূলে রয়েছেন হাবিবুল্লাহ বিন আব্দুল কাদের। আব্দুল কাদের বাড়ি বাগাটিপাড়া এলাকায়। সে নিজেকে ‘ইমাম মাহমুদ’ বলে দাবি করেন। মূলত তার ডাকে ২০-৩০ জন তরুণ-তরুণী ও গৃহিণী বাড়ি ছেড়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে গাজওয়াতুল হিন্দের (পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটাই হলো “গাজওয়ায়ে হিন্দ”) জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দেশে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সংগঠনটির।

জানা গেছে, সংগঠনটির কার্যক্রম কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বছর দুয়েক আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে উগ্রবাদী ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে এক শ্রেণির মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। অনুসারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বলতেন, ‘২০২৩ সাল থেকে পৃথিবী জুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আধুনিক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে প্রাচীনযুগ শুরু হবে। তখন মানুষ আবার ঘোড়া নিয়ে চলাচল করবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকেই। আর এই সময়টাই গাজওয়াতুল হিন্দের সময়’। 

কথিত ‘ইমাম মাহমুদের’ এসব কথায় অনেকেই উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনটিতে জড়িয়ে পড়েন।

এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগ করে মৌলভীবাজারে আস্তানায় জঙ্গিরা
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে সদস্যরা এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে সাংগঠনিক নির্দেশনা আদান-প্রদান করতো। সর্বশেষ সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করার পর হিজরতের সিদ্ধান্ত নেয় এ সংগঠনের সদস্যরা। মাস চারেক আগে থেকে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগের মাধ্যমে গত দুই মাস আগে মৌলভীবাজারে আস্তানা তৈরি করে তারা। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এরই মধ্যে সিটিটিসির অভিযানে সংগঠনটির ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের মধ্যে চিকিৎসকের স্ত্রী থেকে শুরু করে অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণির জঙ্গিরা রয়েছেন।

কমান্ডো ট্রেনিং শেষে করেই ছিল হামলার পরিকিল্পনা
মৌলভীবাজারে জঙ্গি আস্তানায় অংশ নেওয়া পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেপ্তার জঙ্গিরা সাংগঠনিক নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাম্প নির্মাণ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তারা সেখানে কমান্ডো ধাঁচে প্রশিক্ষণ নিতে সমবেত হয়েছিল। অভিযানে প্রশিক্ষণের জন্য আনা কমান্ডো বুটও জব্দ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অস্ত্র সংগ্রহের পর তারা পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারি স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল।

‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে নামিদামি কলেজের শিক্ষার্থীও রয়েছে।

অভিযানে অংশ নেওয়া সিটিটিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের একজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। আস্তানা থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও সংগঠনটির আরও ২০-২৫ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে নটরডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থীও রয়েছে। গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক নির্দেশে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধানে সিটিটিসির অভিযান চলছে।

আরও পড়ুন>>> কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে সিটিটিসির অভিযান

নতুন সংগঠনটির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এ সংগঠনটি অন্য সব জঙ্গি সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই সংগঠনের সদস্যরা দাবি করে তারা কথিত ‘ইমাম মাহমুদের’ অনুসারী। তার নির্দেশে তারা গাজওয়াতুল হিন্দ প্রতিষ্ঠার জন্য ঘর ছেড়েছে। তারা গাজওয়াতুল হিন্দ প্রতিষ্ঠার জন্য (পাকিস্তান, ভারত,বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) যেকোনো ধরনের জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

এদের অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সংগঠনের প্রধানকে গ্রেপ্তার করা গেলে এবং গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের পর এসব তথ্য জানা যাবে।

এদিকে জঙ্গি আস্তানার অভিযান শেষে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠন ব্যাপক সংখ্যক লোকদের উগ্রবাদের দীক্ষা দিয়েছে। আমরা জানতে পারি, মৌলভীবাজারের যেকোনো একটি পাহাড়ে তারা তাদের আস্তানাটি তৈরি করেছে। গতকাল আমরা চূড়ান্ত তথ্য পাই। ঢাকায় আমরা একজনকে গ্রেপ্তার করেছি, যিনি এই জঙ্গি আস্তানা থেকে তার পরিবারকে আনার জন্য গিয়েছিলেন।

সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, বিনা বল প্রয়োগে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। তাদের হেফাজতে নেওয়ার পরে আমরা জঙ্গি আস্তানায় ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৩ কেজি বিস্ফোরক ও ৫০টির মতো ডেটোনেটর উদ্ধার করি। যা দিয়ে গ্রেনেডসহ হাই এক্সপ্লোসিভ তৈরি করা হয়। জঙ্গি আস্তানা থেকে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী। এছাড়া ৩টি শিশুও ছিল। এছাড়া ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ সামগ্রী, কমব্যাট বুট, বক্সিং ব্যাগ এবং কয়েক বস্তা জিহাদি বই জব্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এটি নতুন একটি সংগঠন, এর নাম ইমাম মাহমুদের কাফেলা। বাংলাদেশে যেসব নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আছে, সেগুলোর বাইরে এটি একটি নতুন সংগঠন। এই সংগঠনের যে মূল ব্যক্তি তার নামও আমরা পেয়েছি। আশা করি আমরা তার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হবো।

এমএসি/এসএম