অভ্যন্তরীণ তদন্তে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মুহ. মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। 

সম্প্রতি কমিশন থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) দুদক পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। সংস্থাটি ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

দুদকের ওই সূত্র জানায়, তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিমকে মাহবুবুল আলমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন দুদকের উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক নেয়ামুল গাজী। 

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, মাহবুবুল আলম দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থাটিতে ২৮ বছর আগে পরিদর্শক পদে যোগ দেন। এর পর পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উপ-পরিচালক। তিনি বর্তমানে কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-২ এ কর্মরত রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের অব্যাহতি দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।

মাহবুবুল আলম দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ, অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থে নিজ নামে, স্ত্রী, মেয়ে ছাড়াও নিকটাত্মীয়র নামে রাজধানীর শান্তিনগর ও রামপুরায় বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট, দোকান, গাড়ি, বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ, বরগুনার আমতলী উপজেলায় তার গ্রামে কয়েকশ বিঘা জমিসহ অঢেল সম্পত্তি গড়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান চালায় দুদক। 

তিন বছর অনুসন্ধান শেষে বেশকিছু অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করছে দুদক। তাই একটি বিশেষ সংস্থার মাধ্যমে এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে।

দুদকের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তি মালিক হয়েছেন বলে ২০১৯ সালে কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। 

তার বিরুদ্ধে একই বছরের ৭ নভেম্বর একই ধরনের আরেকটি অভিযোগ জমা পড়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এরপর ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অভিযোগের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দুদকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিতকরণের অনুরোধ জানানো হয়। পরে ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে একই ধরনের আরেকটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। তিন বছর অনুসন্ধান শেষে গত ২৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি।

দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুবুল আলমের নামে দান ও কেনাসূত্রে ১৮টি দলিলে ৪৫৫ শতক জমি এবং ২০ লাখ ১ হাজার ৩০০ টাকা বিনিয়োগসহ ২৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯১ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর গলাচিপা আড়তপট্টিতে ছয়টি দোকান কিনেছেন তিনি। গ্রামে এক কোটি ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা মূল্যের কৃষি জমি রয়েছে তার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাহবুবুল আলমের স্ত্রীর নামে ১৪টি দলিলে ৩৫৪ শতক জমি কেনার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া একটি কোম্পানিতে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। তার মেয়ের নামেও সাতটি দলিলে ১৪৫ দশমিক ৮৮ শতক জমি, ২৬ লাখ টাকার গাড়ি কেনা ছাড়াও পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগসহ অন্যান্য সম্পত্তি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া এক অভিযোগে বলা হয়েছে, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় তার জমি ও তিনতলা একটি ভবন রয়েছে। এছাড়া বরগুনার আমতলীর সোনাখালী গ্রামে তার বসতবাড়িতে দুইতলা ভবন, পটুয়াখালীর পায়রাবন্দরের পাশে কলাপাড়ায় কয়েকশ বিঘা জমি, আমতলী উপজেলায় কয়েকশ বিঘা ধানী জমি ও তিনটি দীঘি, ঢাকার শান্তিনগরে তার টাকায় ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে সাততলা এবং রামপুরায় ছয়তলা ভবন রয়েছে।

অন্যদিকে নয়াপল্টন এলাকায় চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী নামে ২০ তলা মার্কেটে ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে শেয়ার, আমতলী উপজেলায় বাড়ি, হাবিবুর ও তার ছেলের নামে নতুন-পুরাতন গাড়ির শো-রুম, মিরপুরে দীপ্তি আবাসন প্রকল্পের নিকট আত্মীয়ের নামে শেয়ার, সেখানে মালিক দেখানো হয়েছে ফারুক মৃধা, নজরুল ও মশিউরসহ আরও কয়েকজনকে। এছাড়া বোন, বোন-জামাই, ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নামে, শ্যালক ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামেও ঢাকা ও পাবনায় শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে তার। অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, তার নিজ উপজেলা আমতলীর একটি স্কুল ও কলেজে এডহক কমিটির সভাপতি পদ নিয়েও তিনি আইন-বহির্ভূত প্রভাব খাটাচ্ছেন।

গত বছরের শুরুতে ঢাকা অফিসে বদলি হওয়ার আগে মাহবুবুল আলম দুদকের চট্টগ্রাম-২ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে প্রায় চার বছর কর্মরত ছিলেন। তখন চট্টগ্রামে দুর্নীতির অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ছাড়াও প্রভাবশালীদের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরএম/এমএ