জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেল’ চালু করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সেল বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সব ধরনের সহায়তা দেবে। একই সঙ্গে বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে যারা বাংলাদেশে আসতে চান, তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করবে এ সেল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (সংস্থাপন) মো. আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে পেশাদার কূটনীতিক ফেরদৌসি শাহরিয়ারকে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেল’-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পালন শেষে নতুন দায়িত্ব পালনে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন ফেরদৌসি শাহরিয়ার। ইতোমধ্যে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছেন। আগামী সপ্তাহ থেকে সেলের কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে।

নতুন সেলের মহাপরিচালক ফেরদৌসি শাহরিয়ারের অধীনে পরিচালক এবং একজন সহকারী সচিব (অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি) কাজ করবেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেলের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া ফেরদৌসি শাহরিয়ার / ছবি- সংগৃহীত

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেল নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষকদের সহায়তার জন্য সেল চালু করা হয়। এটি স্বল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমরাও সেল গঠন করছি। গত নির্বাচনের সময়ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন নামটা ভিন্ন ছিল। অল্পকিছু দিনের জন্য তিনি দায়িত্বে ছিলেন।

আরও পড়ুন >> পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিসা দিলে পর্যবেক্ষকে আপত্তি নেই ইসির

সেলের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের আগে পুরো বিষয়টি চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসবেন, পর্যবেক্ষণ করবেন। এটি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের গাইডলাইন আছে। এ সেলের কাজ হবে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সহায়তা করা। তাদের সঠিকভাবে গাইড করা। খালি মাঠে বিদেশিদের ছেড়ে দিলে তারা অনেক কিছুই বুঝবেন না। তাদের গাইড করা জরুরি। ওই জায়গাগুলো অ্যাড্রেস করবে সেল। এছাড়া নির্বাচনে যারা পর্যবেক্ষক হয়ে আসবেন, তাদের যাচাই-বাছাই করার কাজ এ সেল করবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সহযোগিতা করার জন্য নয়, এটি করা হচ্ছে অসহযোগিতা করার জন্য। গত নির্বাচনে তো পর্যবেক্ষকদের ভিসা দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি, পর্যবেক্ষকদের যাচাই-বাছাই করার এখতিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেই। এটির এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। তারা (নির্বাচন কমিশন) যাদের নিয়োগ দেবে তাদের ভিসা দেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটিই হওয়া উচিত। তারা (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) কেন যাচাই-বাছাই করবে? এটি (নতুন সেল) তো দলীয়। এটি করে আরও বাধা দেওয়া হবে। অথচ নির্বাচন কমিশন এ দায়িত্ব পালন করলে কিছুটা স্বচ্ছতা থাকত। অন্তত বোঝা যেত, নির্বাচন কমিশন কাদের পর্যবেক্ষণ করতে দিয়েছে।’

গত মঙ্গলবার সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস / ছবি- সংগৃহীত

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২০১৮-এর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিছুদিনের জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন উইংয়ের মহাপরিচালক আ ফ ম গাউসুল আযম সরকারকে। এবার নির্বাচনের প্রায় পাঁচ মাস আগে একেবারে নতুন নামে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেল’ চালু করা হলো। কারণ, এবার অনেক আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন বিদেশিরা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।

আরও পড়ুন >> আলোচনায় ১৮’র বিতর্কিত ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’

সূত্রগুলো আরও বলছে, সম্প্রতি ২০১৮-এর বিতর্কিত ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চার বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রতিনিধি না হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনসহ সরকারের মন্ত্রীরা কীভাবে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন— সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন কমিশন এর দায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়। সেজন্য এ ধরনের ঝামেলা এড়াতে পর্যবেক্ষকদের যাচাই-বাছাই করে ভিসা দিতে চায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চার বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে ইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর দায় চাপানো প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘সম্প্রতি বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো। আমাদের দেশে কত ধরনের ধান্দাবাজ ঘুরে বেড়ায়। কে, কাকে ধরে এনে দাঁড় করিয়ে কথা বলিয়ে দিচ্ছে! যে চারজন এসেছিল, তাদের কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। খালি আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও এ ধরনের লোক কেনা যায়। তুমি আসবা, কথা বলবা…।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার / ছবি- সংগৃহীত

‘এজন্য আমাদের একটা জায়গা থাকা দরকার। যারা আসতে চান, তাদের যাচাই-বাছাই করা এবং বিষয়টি সহজতর করা। এই যে তাদের নিয়ে কথা হলো, তখন যদি আমাদের এ মেকানিজম থাকত (সেল) তাহলে আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারতাম। পররাষ্ট্রের ওপর দায়টা আসত না।’

আরও পড়ুন >> ‘আমরা পালকি পাঠিয়ে কাউকে নির্বাচনে নিয়ে আসব না’

অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন সুজনের বদিউল আলম মজুমদার। বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ ভিসা দেওয়া। তাদের যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব কমিশনের। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন তাদের সঙ্গে দেখা করল কেন? দায়টা নির্বাচন কমিশনের।’

উল্লেখ্য, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সহায়তা সেলের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া ফেরদৌসি শাহরিয়ার বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তা। এর আগে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমেরিকাস অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এনআই/এমএআর/