দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মৃত্যু
আ.লীগের সংঘর্ষ চলাকালে রেজাউলের পায়ে কোপ দিল কারা?
‘ভাইটা আমার ডেঙ্গুর পর জন্ডিসে আক্রান্ত ছিল। ঢাকায় গেছিল মাদ্রাসায় ছুটি নিতে, সঙ্গে চিকিৎসা করাইব। গত ২৮ জুলাই আমার ছোট ভাই হাফেজ রেজাউল গুলিস্তানে যায় ডাক্তার দেখাতে ও ওষুধ কিনতে। ওর সেদিনই সন্ধ্যার মধ্যে ফেরার কথা ছিল বাড়িতে। কিন্তু দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কুপিয়ে হত্যা করা হলো আমার ভাইটিকে। খবর পেয়ে ঢাকায় গিয়া লাশের জন্য ঘুরছি, মামলা করতেও ঘুরছি। লাশ নিয়ে আসার পর কেউ খবর রাখেনি।’
আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে হত্যার শিকার হাফেজ রেজাউল করিমের বোন ফারহানা আফরিন সুমী।
বিজ্ঞাপন
গত ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর গোলাপশাহ মাজারের কাছে সংঘর্ষে জড়ায় কেরানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ। এ সময় হাফেজ রেজাউলসহ পাঁচজনকে কোপানো হয়।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শান্তি সমাবেশ শেষে নেতাকর্মীরা যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখনই ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় এক দলকে সশস্ত্র অবস্থায় এলোপাতাড়ি যাকে তাকে কোপাতে দেখাতে যায়।
শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে এসে সংঘর্ষে জড়ানো অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের এক পক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে, আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে হাফেজ রেজাউল করিমকে। অভিযোগকারী পক্ষের দাবি, রেজাউলকে হত্যা করেছেন ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলামের পক্ষের লোকজন।
আরও পড়ুন : হঠাৎ কর্মসূচিতে রাজধানীতে রাজনৈতিক উত্তাপ
পুলিশের সহযোগিতায় পল্টন থানায় দায়ের করা রেজাউল হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামাদের। ঘটনার ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও হাফেজ রেজাউল করিমকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত রেজাউল করিম (২১) যাত্রাবাড়ী জামিয়া ইসলামীয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায় (বড় মাদ্রাসা) দাওরা হাদিসে পড়াশোনা করতেন। শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণকোটা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে ছিলেন তিনি।
গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) গোলাপশাহ মাজারের কাছে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের মারামারির মধ্যে তিনিসহ পাঁচজন ছুরিকাহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রেজাউল ছিলেন বড়।
রেজাউলের চাচা আজহারুল ইসলাম বলেন, শেরপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করে গত দুই বছর যাবত সে জামেয়া মাদানিয়াতে অধ্যয়নরত ছিল।
তিনি বলেন, ‘গেলো ঈদের আগে ডেঙ্গু জ্বরে বিছানায় পড়ে রেজাউল। বাধ্য হয়ে সে মাদ্রাসা ছেড়ে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে আবার সে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। অনেকদিন বাড়িতে চিকিৎসার পর গত সপ্তাহে ঢাকায় যায় সে। শুক্রবার বিকেলে মাদ্রাসা থেকে ওষুধ কেনার উদ্দেশ্যে নাকি বের হয়েছিল। অথচ পুলিশ ফোন করে পরদিন দিয়েছে তার মৃত্যুর খবর।’
রেজাউলের ভগ্নীপতি মো. জুয়েল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হত্যার ঘটনা শুক্রবার সন্ধ্যায়। খবর পাই পরদিন। শনিবার সারাদিন ঘুরেছি পুলিশ লাশ হস্তান্তর করেনি। পরদিন রোববার দুপুরে মামলা করায়। এজন্যও ঘুরতে হয়েছে। রমনা থানা থেকে পল্টন গিয়েছি। সেখানে গিয়ে মামলা করেছি। এরপর গিয়ে পুলিশ লাশ হস্তান্তর করেছে। অথচ একটা সপ্তাহ পার হলো কেউ খবর নিল না।’
অরও পড়ুন : অলিগলিতে ঢুকে নেতাকর্মীদের পেটানোর অভিযোগ বিএনপির
নিহত রেজাউলের বোন ও মামলার বাদী ফারহানা আফরিন সুমী ঢাকা পোস্টকে বলে, গ্রামে রেজাউলকে সবাই পছন্দ করত। একদম নির্ঝঞ্ঝাট ছেলে। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। অনেকদিন ধরেই ভাইটা অসুস্থ ছিল। ঢাকা গিয়া ভাইটা আমার খুন হলো।’
সুমী বলেন, ‘পল্টন থানায় ফোন দিছি। তদন্তকারী দারোগা কয় মামলা নাকি ডিবি নিয়া গেছে। একটা সপ্তাহ হলো আর কেউ খবর রাখেনি। পুলিশও খোঁজ নেয়নি, কোনো তথ্য জানায়নি। এতো আসামি ধরে, চোর ডাকাত সন্ত্রাসী ধরে আমার ভাইটার খুনিদের ধরতে পারল না?
গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) বিএনপির মহাসমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। শান্তি সমাবেশ শেষে ফেরার সময় সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকরা।
সংঘর্ষের সময় রাস্তায় থাকা নেতাকর্মীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। এক পর্যায়ে এক পক্ষের ধাওয়ায় অন্য পক্ষ সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের দিকে চলে যায়। সংঘর্ষের পর পাঁচজনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা রেজাউলকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত মো. আরিফুল (১৮), জোবায়ের (১৮), রনি (৩২) ও মোবাশ্বেরকে (২৮) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পড়ে আহত হয়ে নয়, ছুরিকাঘাতেই মৃত্যু হয়েছে রেজাউলের
পল্টন থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পল্টন মডেল থানাধীন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে পাকা রাস্তার উপর পথচারী লোকজনদের মধ্যে মারামারি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় এবং কয়েকজন লোক আহত হয়। কিছুক্ষণ পর ঘটনার জের ধরে গোলাপশাহ মাজারের আশপাশে পুনরায় অবৈধ জনতাবদ্ধে মারামারি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এর মাঝখানে পড়ে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হাফেজ রেজাউলসহ কয়েকজন পথচারী গুরুতর আহত হয়।
মামলায় ও পুলিশি সুরতহালে উল্লেখ করা হয়েছে, দুষ্কৃতিকারীদের ছুরির আঘাতে হাফেজ রেজাউলের বাম পায়ের হাঁটুর উপরে পেছনের অংশে দুইটি গুরুতর কাটা রক্তাক্ত জখম হয় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
যোগাযোগ করা হলে কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওই দিন ঘটনার সময় পাঁচজন আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুজন আমার কর্মী। তারা হলেন, রনি ও আরমান। বাকি তিনজন পথচারী। যে মারা গেছেন হাফেজ রেজাউলও ছিলেন পথচারী। নিহত রেজাউলসহ আহতদের চিকিৎসা খরচ আমি বহন করেছি।’
আরও পড়ুন : উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ, কী হয় কী হয়?
চেয়ারম্যান শাহীন বলেন, ‘এই হত্যাসহ আহতদের এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে অ্যাডভোকেট কামরুলের অনুসারী কামরাঙ্গীরচরের হোসেন কমিশনার ও তার ক্যাডার বিপ্লব ও শিমুল। হোসেন কমিশনারের নেতৃত্বে যাকেই পেয়েছে তাকেই কোপানো হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল আমার গ্রুপের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা।’
তিনি বলেন, ‘শান্তি-সমাবেশে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শেষে যখন আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে ফিরছিলাম, পার্টি অফিস পার হওয়ার পর পেছন থেকে ধাওয়া ও হামলা করা হয়। তখন আমার সঙ্গে ছিল ৪-৫ হাজার নেতাকর্মী। কেউ মারামারির উদ্দেশ্যে আসেনি, খালি হাতেই এসেছিল।’
তিনি বলেন, ‘এর আগেও আমার দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। উদ্দেশ্যই ছিল আমার ওপর হামলা। কারণ আমি তার প্রতিদ্বন্দ্বী, ঢাকা-২ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী। দিনে দিনে আমার সমর্থনও বাড়ছে। আমি যেন কোনো কারণে রিঅ্যাকশন করি সেজন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করছেন।’
সেদিন ছিল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ। অথচ আপনাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মৃত্যু হল সাধারণ পথচারীর! বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান শাহীন বলেন, ‘আমি খুবই মর্মাহত, এটা দুঃখজনক ঘটনা। আমি চাই এটার সুষ্ঠু তদন্ত হোক, যারাই জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’
অন্যদিকে ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেদিন কি হয়েছিল, সে ব্যাপারে কে কী বলল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে যে ছেলেটি মারা গেছে সে ছেলেটি দুই গ্রুপের মধ্যে ঠেলাঠেলিতে রাস্তায় পড়ে আহত হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মারা গেছেন। কে কি অভিযোগ করছে সেটা আমলে নিচ্ছি না।’
রেজাউল হত্যা মামলা ডিবিতে
পল্টন থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঘটনা গোলাপ শাহ মাজারের আশেপাশে। আমরা সম্ভাব্য হত্যাকারীদের শনাক্তে চেষ্টা করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। সেদিন তো ঘটনাস্থলসহ আশপাশে অনেক মানুষ ছিল।’
ওসি বলেন, ‘আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন সাধারণ মানুষ। ঘটনায় আহত হয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে একজন রাজনৈতিক কর্মী। তিনি কেরানীগঞ্জ যুবলীগের কর্মী। বাকি সবাই পথচারী। এই মামলাটি পল্টন থানা পুলিশ থেকে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে এখন তারাই আপডেট বলতে পারবেন।’
যোগাযোগ করা হলে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রাজিব আল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ মাত্র একদিন হলো মামলাটি হাতে পেয়েছি। কোনো আসামি শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারিনি।’
রাজনৈতিক টালমাটাল এ অবস্থার মধ্যে অনেককে ধরছে পুলিশ, কার বাসায় কোন আসামি আশ্রয় নিচ্ছে, মামলার আসামি বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও ধরা পড়ছে, অথচ হাফেজ রেজাউল খুনের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। খুনিদের শনাক্তে কতদিন সময় নেবে পুলিশ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করলে অনেক প্রশ্নই করা যায়। পুলিশের জায়গায় দাঁড় করালে অনেক কিছুই করা যায় না। লাখখানেক মানুষের মাঝে খুনি শনাক্ত করা তো কঠিন। আমরা এলোপাতাড়ি কাউকে ধরিও না। আমরা মাত্র মামলাটা হাতে পেয়েছি, একটু তো সময় দিতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা হবে। কতদিন লাগবে সেটা বলা মুশকিল। তবে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’
শহীদ হাফেজ রেজাউল করীমের মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান ও যাত্রাবাড়ী মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমার ছাত্ররা হলো আমার প্রাণ। সুতরাং আমার কি কষ্ট কম হচ্ছে? এ ঘটনায় আমি কট্টর প্রতিবাদ জানিয়েছি। এটাও বলেছি যে, সে কীভাবে মারা গেল সেটা জানি না তবে, কেন মারা গেল সেটার কঠিন বিচার করতে হবে। এর ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। সারা দেশের মাদারিসে কওমিয়ার ছাত্র ও উস্তাদদের নিরাপত্তা দিতে হবে। কারাবন্দি সকল আলেমদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। তারা আমার থেকে ২-৪ দিন সময় নিয়েছে। আমি তাদেরকে ৭ দিন সময় দিয়েছি। আমি তাদের সান্ত্বনা নয়; কাজ দেখতে চাই।’
জেইউ/এসকেডি