ডিজিটাল বাংলাদেশে ‘সত্যায়নে’র প্যাঁচ আর কতদিন?
সরকারি চাকরির আবেদনে কিংবা মৌখিক পরীক্ষার সময় ছবি ও শিক্ষা সনদসহ বিভিন্ন কাগজপত্র সত্যায়ন করতে হয়। সত্যায়ন করার ক্ষমতা আছে কেবল প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের। এমন অনেক চাকরিপ্রার্থী আছেন যারা গেজেটেড কর্মকর্তা খুঁজে পান না।
ফলে কাগজপত্র সত্যায়ন করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে নীলক্ষেত থেকে কোনো এক কর্মকর্তার নামে নকল সিল বানিয়ে সত্যায়ন করে নেন।
বিজ্ঞাপন
এ পদ্ধতির এখন আর প্রয়োজন দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনসহ বহুভাবে বেশ সহজেই একজন মানুষের তথ্য যাচাই করা যায়। তাই সত্যায়ন প্রক্রিয়ার চলমান নিয়ম আর দরকার নেই
বহুদিনের পুরোনো এ পদ্ধতির এখন আর প্রয়োজন দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনসহ বহুভাবে বেশ সহজেই একজন মানুষের তথ্য যাচাই করা যায়। তাই সত্যায়ন প্রক্রিয়ার চলমান নিয়ম আর দরকার নেই। এই পদ্ধতি চাকরিপ্রার্থীসহ অনেকের জন্য হয়রানির কারণ হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো উপকার নেই। আবার নকল সিল বানিয়ে অনেকে এ পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে।
সরকারি চাকরির আবেদনকারীদের অভিযোগ, পরিচিত না হলে বেশিরভাগ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা কাগজপত্র সত্যায়নই করতে চান না। আবার এটা নিয়ে বেশ বিরক্ত সত্যায়নকারী কর্মকর্তারাও। তাদের দাবি, এতে গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ নষ্ট হয় এবং সময়ের অপচয় হয়। অজানা মানুষের সত্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিও থেকে যায়।
সম্প্রতি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ইকরামুল হক। বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে আবেদনের পরিকল্পনা করছেন তিনি। সম্প্রতি ডাক বিভাগের একটি অস্থায়ী পদে আবেদন করেন তিনি।
ঢাকা পোস্টকে এ চাকরিপ্রার্থী বলেন, আবেদনপত্রের সঙ্গে সদ্য তোলা দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সত্যায়িত অনুলিপি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি পাঠাতে বলা হয়। আমি কাগজপত্র ফটোকপি করে খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার কাছে সত্যায়ন করতে যাই। কিন্তু তিনি আমাকে চেনেন না বলে সত্যায়ন করেননি। আমি খুবই হতাশ হলাম। এরপর পাশের রেল ভবনে গিয়ে একজন কর্মকর্তাকে কয়েকবার অনুরোধ করার পর তিনি সত্যায়ন করে দেন।
তিনি বলেন, সত্যায়ন প্রক্রিয়াটা আমাদের মতো চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এখন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমিরুল ইসলাম নামে আরেক চাকরিপ্রার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিচিত না হলে বেশিরভাগ কর্মকর্তাই সত্যায়ন করতে চান না। তখন এটা বাড়তি ঝামেলা আর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শহরের চেয়ে গ্রামে দুর্ভোগ বেশি
শহরে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা অনেক থাকলেও গ্রামে তা একেবারেই কম। এটি সেখানকার চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আরও বেশি দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে। এমনকি গ্রামের লোকেরা ‘নীলক্ষেত’ আদলে নকল সিলের ব্যবস্থাও করতে পারেন না। ফলে সেখানে সত্যায়ন একটা বড় ভোগান্তির নাম
বেশ কয়েক বছর ধরে চাকরির পেছনে ছুটছেন এমন একজন কুমিল্লার বাসিন্দা আতিকুল ইসলাম।
এ চাকরিপ্রার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে রেলওয়েতে একটি পদে চাকরির আবেদন জমা দেওয়ার জন্য কাগজপত্র সত্যায়নের প্রয়োজন হয়। আমি কুমিল্লা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের একজন কর্মকর্তার কাছে যাই। সবগুলো পরীক্ষার মূল সনদ দেখানোর পরও ওই কর্মকর্তা আমাকে সত্যায়ন করে দেননি। তার কথা, আমাকে তিনি চেনেন না। পরিচিত আর কাছাকাছি আর কোনো প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা না থাকায় আমি আর সেই চাকরিতে আবেদন করিনি।’
আবির হোসাইন নামে ফেনী জেলার এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, গ্রামাঞ্চলে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা শহরের মতো অ্যাভেইলেবল নয়। এছাড়া অল্প যে কজন আছেন, তারাও আমাদের চেনেন না। তাই কাগজপত্র সত্যায়ন করা আমাদের জন্য অনেক বিড়ম্বনার।
‘বাধ্য’ হয়ে জাল সিল
স্নাতক সম্পন্ন করে গত ২ বছর যাবত সরকারি চাকরিতে আবেদন করছেন আশিকুর রহমান (ছদ্মনাম)। এ পর্যন্ত ৩০টি চাকরিতে আবেদন করেন তিনি।
ঢাকা পোস্টকে এ চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘যতগুলো আবেদন করি প্রায় সবগুলোতেই সত্যায়ন করতে হয়। একটা আবেদনের কাগজপত্র সত্যায়ন করতেই কষ্ট হয়ে যায়, এতগুলো কীভাবে করব। এক বন্ধুর পরামর্শে নীলক্ষেত থেকে ১০০ টাকা দিয়ে একটি সিল বানিয়ে এনে নিজেই সত্যায়ন করা শুরু করি। এ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা হয়নি!’+
আশিকুর রহমান বলেন, ‘কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সত্যায়ন করতে গেলে তারা নানা অজুহাত দেখান। এজন্য বাধ্য হয়ে নিজে সিল বানিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীলক্ষেতে বেশ কয়েকটি দোকানে ৫০-১০০ টাকায় এসব সিল বানিয়ে বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে ডাক্তার ও শিক্ষকদের সিল বেশি বানানো হয়। অথচ যার নামে সিল বানানো হচ্ছে তিনি বিষয়টি জানেনও না।
সত্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিরক্ত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারাও
সত্যায়ন করতে বিরক্ত হন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তারাও। এ বিষয়ে ৩ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। সত্যায়ন প্রক্রিয়া সরকারি সিদ্ধান্ত বলে এ বিষয়ে কথা বললেও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান তারা।
তাদের ভাষ্য, সত্যায়ন করতে সময় অপচয় হয়। এছাড়া কাগজপত্রের ক্ষেত্রে কেউ প্রতারণার আশ্রয় নিলে দায় তার উপরে আসবে এমন ভয়ও থাকে। অনেক কর্মকর্তা মনে করেন এ যুগে পুরোনো আমলের এ পদ্ধতির আর প্রয়োজন নেই।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেখা গেছে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি, হঠাৎ একজন এসে বললেন কাগজগুলো সত্যায়ন করে দিতে। তখন কেমন লাগবে বলুন? একদিকে কাজের মনোযোগ নষ্ট হয় অন্যদিকে সময়ও অপচয় হয়। তখন সবমিলিয়ে এটা আমার জন্য একটা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
মৎস্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাউকে না চিনে কেন তার কাগজপত্র আমি সত্যায়ন করব? তিনি যদি কাগজপত্রের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকেন, সত্যায়ন করে কেন আমি সেই দায় নেব?’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার কথা হলো, এই আধুনিক যুগে এসেও সত্যায়ন প্রক্রিয়া কেন থাকবে? আমার মতে এটা দ্রুত উঠিয়ে নেওয়া উচিত।’
যাচাই-বাছাইয়ের অনেক মাধ্যম, বাদ যেতে পারে ‘সত্যায়ন’ প্রক্রিয়া
সত্যায়ন প্রক্রিয়া বাদ দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারও।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন যেহেতু যাচাই-বাছাইয়ের অনেক মাধ্যম আছে, তাই সত্যায়ন প্রক্রিয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এই প্রক্রিয়া এখন বাদ দেওয়া যেতে পারে।’
ছাত্র জীবনেও দেখেছি, একটা সিল মেরে দিলেই হলো : জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, আমাদের টার্গেট স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নমেন্টস বা সরকার ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় আমাদের মাথার মধ্যে আছে। আপনারা কিছুদিনের মধ্যে দেখবেন, সব ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে এ সত্যায়ন প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা আছে কি না, এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা আমারও কথা। আমরা ছাত্রজীবনেও দেখেছি। একটা সিল মেরে দিলেই হলো। যদিও আমারটা অরিজিনালি আছে।’
তিনি বলেন, ‘এ ডিজিটালাইজেশনের যুগে আপনারা নিশ্চয়ই দেখছেন- আমরা প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো আনছি। আমাদের কিন্তু এখন বিগ ডাটা। ভোটার আইডিতে এগুলো সব থেকে যাবে। আপনার ভোটার আইডি কার্ড দেন, কোথায় কোথায় লেখাপড়া করেছেন, আপনার সার্টিফিকেট- সব চলে আসবে। আপনি চাইলেই একসঙ্গে অনেক ডাটা দেখে নিতে পারছেন।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যখন এটা করব, তখন মানুষের একটা কোড নম্বর থাকবে। সেই কোডটা দিলে আসল নাকি নকল সেটা আপনি দেখে নিতে পারবেন। এটা হবে ডিজিটাল বেজড। স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেখানে আমাদের প্রত্যেকটা কাজ সহজ হয়ে যাবে। তখন এটার (সত্যায়ন) কোনো প্রয়োজন হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কথা দিচ্ছি, আমরা যত দ্রুত পারি এ বিষয়ে কাজ করে এগুলো সহজ করে দেব, যেন কারো ভোগান্তি না হয়।’
সত্যায়ন কী?
‘সত্যায়ন’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে সত্যতা নিশ্চিতকরণ। ইংরেজি ভাষায় একে বলা হয় attestation. ‘Attest’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য দেওয়া, নিশ্চিতরূপে বলা, প্রমাণ করা, প্রকাশ করা ইত্যাদি।
চাকরির আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া কাগজপত্র আসল কি না অথবা আসল ডকুমেন্টের অনুলিপি কি না, তা নিশ্চিত করার জন্যই মূলত সত্যায়িত করতে বলা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, কাগজপত্রে একজন সই করে সাক্ষ্য দেবেন। সাক্ষী এমন ব্যক্তি হবেন, যার সাক্ষ্য বিশ্বাস করার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা, অষ্টম গ্রেড থেকে তদূর্ধ্ব, বিশেষ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য, মেয়র বা স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, সরকারি গণমাধ্যমের সম্পাদকসহ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সত্যায়নের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
এসএইচআর/এআর/এমজে