প্রেসে জোড়া খুনের রহস্য ৬ বছর পর উদঘাটন করল পিবিআই
রাজধানীর পুরান ঢাকার কদমতলী এলাকায় কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস নামে একটি প্রেসে হওয়া জোড়া খুনের রহস্য ৬ বছর পর উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বুধবার (২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থার প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
বিজ্ঞাপন
যেভাবে ঘটনার শুরু
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নিহত সোহেল ও তার প্রতিবেশী চাচা ইকবাল হোসেন পুরান ঢাকার কদমতলী থানার কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে কাজ করতেন। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কারখানায় থাকতেন। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর কর্মচারী হাসান মিয়ার স্ত্রী পারভীন বেগমকে ফোন করে প্রেসের অন্য কর্মচারীরা জানান, রাত ৩টার দিকে সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে আহত করে ইকবাল পালিয়ে গেছেন।
গুরুতর আহত অবস্থায় প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্থপথের ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই সাইদুর রহমান (২৮) বাদী হয়ে ইকবালের (৫৫) বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। এরই মধ্যে ৮ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহেল মারা যায়।
যেভাবে চাচা-ভাতিজা হত্যা
তিনি জানান, প্রেসের কর্মচারীরা প্রচার করেন, ৬ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে চাচা ইকবাল নামাজ পড়তে ঘুম থেকে উঠেন। এ সময় রুমের লাইট জ্বালানোকে কেন্দ্র করে চাচা-ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এ সময় লোহার রড দিয়ে ইকবাল তার ভাতিজা হোসেনকে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যায়। এর ৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকার বিক্রমপুর স্টিল মিলের পাশের একটি গাছের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ইকবালের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাকে প্রেসের কর্মচারীরা প্রচার করেন, নিজের অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ইকবাল। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে পুলিশ।
কদমতলী থানায় দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি ইকবালের মরদেহ উদ্ধার হওয়ায় ২০১৮ সালে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ইকবালের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি হত্যা উল্লেখ করায় প্রেসের ১০ কর্মচারীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ইকবালের স্ত্রী পারভীন বেগম।
মামলাটি রূপগঞ্জ থানা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে ৬ প্রেস কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু কোনো ধরনের তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
জোড়া খুনের রহস্যের জট খোলে পিবিআই
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ইকবাল হত্যা মামলার তদন্তে নেমে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কারখানায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া গাড়ির খোঁজে নামেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গাড়ি ও সেই সময়ে গাড়ির চালক নুর আলম ও তার মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়। কিন্তু নুর আলমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি অন্য এক চালকের। নুর আলম নিজেকে আড়াল করতে অন্যের নম্বর ব্যবহার করেন।
পিবিআই প্রধান বলেন, নিহত ইকবাল ছিলেন পরহেজগার ও নামাজি ব্যক্তি। তিনি নামাজের জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। আর কর্মচারীরা রাতভর জেগে থেকে মধ্যরাতে ঘুমাতে যেতেন। ফলে এ সময় রুমের লাইট জ্বালাতেন। আর এই লাইট জ্বালানো নিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হতো।
ঘটনার দিন ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর রাত ৩টায় প্রথমে প্রেস কর্মচারী আব্দুর রহমানের সঙ্গে ঝগড়া, হাতাহাতি ও মারপিট হয়। এ সময় অন্য কর্মচারীরাও ইকবালকে মারধর করে। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের ফলে তারা সকলে মিলে ইকবালকে মারপিট ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তখন তার প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেল তার চাচা ইকবালকে বাঁচাতে গেলে আসামিরা তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাথারি মারপিট করে আহত করে। এরপর আসামি জামাল তার পূর্ব পরিচিত পিকআপ ড্রাইভার নূর আলম এবং গাড়ির মালিক বাদলের সঙ্গে কথা বলে ২০ হাজার টাকায় পিকআপ ভাড়া করে।
পিকআপ মালিক বাদল এবং ড্রাইভার নূর আলম পিকআপটি প্রেসে নিয়ে আসে। একদিন পর মরদেহটি গাড়িতে করে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বরপায় নিয়ে গিয়ে লাশের গলায় গামছা পেঁচিয়ে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে।
পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জমান মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা। তিনি কদমতলীর চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়ে যাওয়ার পরেও পুনঃতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ প্রদান করলে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) মামলাটি তদন্ত করে।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) সোহেল হত্যা মামলায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার ও শোন এরেস্ট করে। দুটি মামলাতেই তদন্তে হত্যা ও মরদেহ গুমের সঙ্গে মোট ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পায় পিবিআই। তবে হত্যায় জড়িত এক আসামি মৃত্যু ও দুজন পলাতক রয়েছে। এ ২টি মামলাতেই দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন পিবিআই প্রধান।
জেইউ/এসকেডি