চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত আইনজীবী অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক বাপ্পী (৩৩) হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত স্ত্রী রাশেদা বেগমকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যরা। তবে গ্রেপ্তারের পরপরই আসামি রাশেদাকে নিয়ে নতুন করে বিপাকে পড়ে সংস্থাটি। কারণ মাত্র কয়েকদিন আগে রায় ঘোষণা হওয়ায় তার সাজা পরোয়ানা এখনো স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজারে চকরিয়া থানায় পৌঁছায়নি।

একারণে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) শরণাপন্ন হয় র‍্যাব। তিনি আসামিকে চকবাজার থানায় হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। এরপর রাশেদাকে নিয়ে যাওয়া হয় চকবাজার থানায়। কিন্তু ওইসময় থানায় কোনো পরোয়ানা না থাকায় আসামি রিসিভ করতে চাননি। একপর্যায়ে মহানগর পিপি চকবাজার থানার ওসিকে আসামিকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হত্যা মামলার রেফারেন্স দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করতে বলেন।

তার পরামর্শে রোববার (৩০ জুলাই) চকবাজার থানা পুলিশ আসামি রাশেদাকে আদালতে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।

আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারায় মানে হলো, শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো ব্যক্তিকে পুলিশের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা।

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসামি রাশেদাকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে রোববার সকালে চকবাজার থানায় হস্তান্তর করে। তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা না থাকায় আমরা সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করেছি।

এ বিষয়ে মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসামি রাশেদা আইনজীবী বাপ্পী হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। তাকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে সাজা পরোয়ানা না থাকায় আইনি জটিলতা নিয়ে আমার মতামত চেয়েছেন। আমি আসামিকে চকবাজার থানায় হস্তান্তরের জন্য বলেছি। এরপর চকবাজার থানাকে হত্যা মামলার রেফারেন্স উল্লেখ করে ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠাতে বলেছি।

৫৪ ধারা জামিনযোগ্য এবং আসামি রাশেদার জামিন হয়ে যাবে কি না জানতে চাইলে পিপি আবদুর রশীদ বলেন, তাকে জামিন দিতে পারবে না। কারণ আসামি ফরোয়ার্ডিংয়ের সময় হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বলে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগেও আসামি রাশেদা চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া থানার একটি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কৌশলে জামিন নিয়ে পলাতক ছিলেন। অথচ মাদক মামলায় কারাগারে থাকার সময় তিনি বাপ্পী হত্যা মামলায় কাগজে-পত্রে পলাতক ছিলেন। বিষয়টি হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানাজানির পর কেউ তাকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেননি। এমনকি এই প্রতিবেদক ওইসময় সংশ্লিষ্ট দুজনকে জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ বিষয়ে গত ২৬ জুলাই ঢাকা পোস্টে 'জানাজানির পরও ফসকে গেল ফাঁসির আসামি!' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে র‍্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।

গত ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালত আইনজীবী অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক বাপ্পী (৩৩) হত্যা মামলায় স্ত্রী রাশেদা বেগম (২৭) ও হুমায়ুন রশিদ (২৮) নামে একজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার আদেশ দেন। একই সঙ্গে আসামি আল আমিন (২৮), আকবর হোসেন ওরফে রুবেল ওরফে সাদ্দাম (২৩) এবং মো. পারভেজ ওরফে আলীকে (২৪) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ২ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। এছাড়া মামলার আসামি জাকির হোসেন ওরফে মোল্লা জাকিরকে (৩৫) খালাস দেয় আদালত।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, বাপ্পী ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বারের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তার গ্রামের বাড়ি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার চৌমুহনী এলাকায়। তার বাবার নাম আলী আহমেদ। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বাপ্পী। হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন বলে জানতেন আত্মীয়-স্বজনরা।

২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর নগরের চকবাজার থানার কে বি আমান আলী রোডে বড় মিয়া মসজিদের সামনে একটি ভবনের নিচতলার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তার হাত-পা ও মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো এবং স্পর্শকাতর অঙ্গ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনার পর বাপ্পীর বাবা আলী আহমেদ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান বাকলিয়া থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইয়াসিন আরাফাত। এদিকে বাপ্পী হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। আইনজীবীদের আন্দোলনের মুখে টানা অভিযান চালিয়ে ঘটনার দুদিন পর ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে রাশেদা বেগমসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একই সঙ্গে মামলাটি পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট অধিগ্রহণ করে পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে। এরপর তিনি তদন্ত করে বের করেন হত্যার নেপথ্যের কাহিনি।

যে বাড়ি থেকে বাপ্পীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সে বাড়ির কেয়ারটেকার ওই সময়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই নারী (রাশেদা) তার স্বামীসহ থাকবেন বলে বাসা ভাড়া নেন। ঘটনার রাতে ওই বাসায় থাকতে যান বাপ্পি। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

তদন্তকারীরা জানান, দেলোয়ার নামে এক ইয়াবা পাচারকারীর স্ত্রী ছিলেন রাশেদা বেগম। স্বামীর মামলার সূত্র ধরে আইনজীবী বাপ্পীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তারা গোপনে বিয়ে করেন।

আসামিদের গ্রেপ্তারের পর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তারা জানিয়েছেন, আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। রাশেদাকে দুই লাখ টাকা কাবিননামায় বিয়ে করেন বাপ্পী। এ নিয়ে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন তিনি। সেই টাকা দুই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫-১০ লাখ টাকা করার পরিকল্পনা করেন রাশেদা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন্ধু হুমায়ুনের মাধ্যমে চার যুবককে ভাড়া করেন রাশেদা। পরিকল্পনা অনুযায়ী খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিতে গিয়ে রাশেদা ওই পাঁচ যুবকের সহযোগিতায় বাপ্পীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

২০১৮ সালে ৫ এপ্রিল পরস্পর যোগসাজশে বাপ্পীকে হত্যার অভিযোগে রাশেদাসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে আদালতকে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ২০২০ সালে ১৫ অক্টোবর আলোচিত মামলাটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচারিক পর্যায়ে মামলাটিতে ২৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ১২ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শেষে ২৬ জুলাই রায় ঘোষণা করেন আদালত।

এমআর/এসএম