জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ‘ব্যতিক্রমী’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাসস্থান তৈরি করা হয়েছে কক্সবাজারে সদরের খুরুশকুলে। বিশ্বে এ ধরনের বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প থাকার কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন সেখানে বসবাসরত মানুষজন। উপকারভোগীরা ঢাকা পোস্টকে জানান, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। সরকার তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে আশ্রয় না পেলে জীবন বাঁচিয়ে টিকে থাকাটাই তাদের জন্য কষ্টকর ছিল।

খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তরা জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতি বছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামান স্বাধীনতার পর দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে দেশের প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন।
 
তারা জানান, ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে কক্সবাজারের জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিতব্য মোট পরিবার ৪৪০৯টি। প্রকল্পের মোট জমি ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর। এতে ব্যয় হবে ১,৪৬৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।

তারা আরও জানান, ৫তলা বিশিষ্ট মোট ভবন রয়েছে ১৩৯টি। প্রকল্প এলাকায় মোট জোন চারটি, প্রতিটি ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৩২টি, প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন (নিট ব্যবহারযোগ্য ৪০৬.৭ বর্গফুট), প্রতি তলায় কমন সার্ভিস সুবিধা রয়েছে। প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে বাঁকখালী নদীর ওপর কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুলের ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ, প্রকল্পের প্রবেশ পথ দুটি, অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার, উপকারভোগীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ ১৪টি, পুকুর তিনটি, মসজিদ একটি ও মন্দির রয়েছে একটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফজাল হোসেন জানান, প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ২০টি ভবন নির্মিত হয়েছে। ৬০০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসিত পরিবারের জীবিকার সুবিধার্থে আধুনিক শুঁটকি মহাল, জীবনমান উন্নয়নের জন্য ৯৫ একর জায়গার ওপর শেখ হাসিনা টাওয়ার স্থাপন ও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

তিনি জানান, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া উপকারভোগীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে আসার আগে কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকায় তিন সন্তান নিয়ে থাকতেন সেলিম মাঝি। তিনি বলেন, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকার আমাকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। এখানে একটি বেড রুম, একটি ড্রয়িং-ডাইনিং, একটি রান্না ঘর ও একটি ওয়াশরুম রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে সমুদ্রে মাঝি হিসেবে কাজ করছি। এয়ারপোর্টের পশ্চিম পাশে আমার নিজের টাকা দিয়ে ৫ গন্ডা জমি কিনে বাড়ি করেছি। সেখানে গাছপালা লাগিয়েছিলাম। এখন ৮/১০ দিনের জন্য সমুদ্রে চলে যাই। প্রতিটি ট্রিপেই পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। আগে ঘূর্ণিঝড়ের সময় পরিবার-পরিজনদের নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। নিজে সমুদ্রে থাকলেও এখন পরিবার নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, এটা সরকারের জন্য সম্ভব হয়েছে।

বাঁকখালী ভবনের বাসিন্দার আজিমের পাঁচ সদস্যের সংসার। তিনি বলেন, আইবিবি মাঠে লোড-আনলোডের কাজ করতাম। এখন চায়ের দোকান দিয়ে সংসার ভালো চলছে। আমাদের বিল্ডিংয়ের ৯ সদস্যের কমিটি আছে। তাদের সিদ্ধান্তে দোকান নিয়েছি। মাসে এক হাজার টাকা ভাড়া দিই। সেই টাকা দিয়ে বিল্ডিংয়ের আনুষঙ্গিক কাজ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, কুতুবদিয়া এয়ারপোর্টের ভেতরে আমার বাসা ছিল। সেখানে তিন শতক জমি ছিল। সরকার এখানে আমাদেরকে থাকার জায়গা দিয়েছে। বর্তমানে অনেক ভালো আছি।

কক্সবাজারে সরকারের নেওয়া এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, বর্তমান সরকার কক্সবাজারবাসীর অনেক প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এতে তারা সম্মানিত হয়েছেন বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, ঢাকার পরই সরকার সবচেয়ে বেশি মেগা প্রজেক্ট নিয়েছে আমাদের কক্সবাজারে। এই বদলে যাওয়া কক্সবাজারই ছিল আমাদের স্বপ্ন।

এমএসআই/এসএসএইচ/