>> শর্ত না মানলে ভবিষ্যতে মিলবেনা অনুমতি : ডিএমপি
>> পুলিশ মনে করলে সমাবেশ বাতিল : সাবেক আইজিপি
>> অনুমতি পেয়ে না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত : আ. লীগ
>> শর্ত মেনেই সমাবেশ করার চেষ্টা করি আমরা :  বিএনপি
>> রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আবার কীসের অনুমতি : মেনন

জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। মাঠে ফিরছে রাজনৈতিক উত্তাপ। মিছিল, মিটিং ও সমাবেশসহ ডাক দেওয়া হচ্ছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির। মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখাচ্ছে পুলিশ। সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দলকে শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি পালনের অনুমতিও দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

ডিএমপির অনুমতি মেলার পর ২৩ দফা শর্তের বেশির ভাগই মানেনি বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। কোথাও কোথাও সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী রাখা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, শব্দযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ, রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার মতো বেশকিছু জনগুরুত্বপূর্ণ শর্ত ভঙ্গ করতে দেখা গেছে দল দুটিকে।

এ বিষয়ে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জনসভা ও শোভাযাত্রাসহ যেকোনো দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন এবং সেখানে যোগদানের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। তবে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। শর্ত দিলেই যে সব শর্ত পরিপালন হবে তা নয়। শর্ত দেওয়া হয় জননিরাপত্তা, কর্মসূচি পালন নির্বিঘ্ন করা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে। যেসব দল শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি পালনের অনুমতি পেয়েও তা পরিপালন করছে না তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি বিবেচনা করা হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মতো ঘটনা ঘটলে সুযোগ আছে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ারও।

পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমতি যেমন পুলিশ দিতে পারে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা থাকলে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে বা অনুমতি বাতিল করতে পারে। ডিএমপিতে এটি বিশেষভাবে মনিটরিং করা হয়। তবে, শর্ত দেওয়া হয় যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সে জন্য। এরপরও অনেক ঘটনাই ঘটে। এসব এখন আমলে নেওয়ার সময় এসেছে।

তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, সভা-সমাবেশ করা রাজনৈতিক অধিকার। সেখানে নিরাপত্তার অজুহাতে অনুমতি না দেওয়া বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি। যে পরিমাণ শর্ত দেওয়া হয় তা আসলে মানা সম্ভব নয়। তবে, চেষ্টা থাকে তা পরিপালনের।

২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল, সভা-সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল ডিএমপি। তখন অনেক রাজনৈতিক দল বিবৃতি দিয়ে সমালোচনা করেছিল।

সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি কর্তৃক সমাবেশ ডাকার পর আওয়ামী লীগও সমাবেশের ডাক দেয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ২৩ শর্তে গত ১২ জুলাই রাজধানীর পল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। অন্যদিকে, ২৩ শর্তে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগকেও অনুমতি দেয় ডিএমপি। শুধু সময় ও স্থান আলাদা।

পরবর্তীতে দেখা যায়, ডিএমপির দেওয়া ২৩ শর্তের মধ্যে বিএনপি সাতটি এবং আওয়ামী লীগ আটটি শর্ত ভঙ্গ করে সমাবেশ করে।এরপর বিএনপির ডাকা পদযাত্রা কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা কর্মসূচির ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। ডিএমপি দুই দলকেই অনুমতি দেয় ২৩ শর্তে।

ডিএমপির দেওয়া উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হলো- দুই দলের কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন, আগতদের হ্যান্ডহেল্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিং, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, অনুমোদিত স্থানের বাইরে অর্থাৎ রাস্তায় বা ফুটপাতের কোথাও লোক সমবেত না হওয়া, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করা, লাঠিসোঁটা/ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে লাঠি, রড ব্যবহার না করা। এর মধ্যে অনেক শর্তই মানেনি উভয় দল। বরং মিরপুর বাঙলা কলেজ এলাকায় সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। পরে থানায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

শর্তসাপেক্ষে অনুমতি পেয়ে শর্ত না মানা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে ডিএমপির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, শর্ত দেওয়া হয় যাতে বড় ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কিছু না ঘটে। কারণ, এসব কর্মসূচিতে অনেক ধরনের মানুষ আসে। নিরাপত্তার বিষয়টি তাই গুরুত্বপূর্ণ। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে দায়টা ডিএমপির ওপরই বর্তাবে।

কোনো দল যদি শর্ত ভঙ্গ করতেই থাকে সেক্ষেত্রে সেই দল বা নেতার বিরুদ্ধে ডিএমপি কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে– এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, কোনো দল যদি অনবরত শর্ত ভঙ্গ করতেই থাকে সেক্ষেত্রে আইনগত কঠোরতা প্রয়োগের সুযোগ ডিএমপির আছে। সেটা ডিএমপি কমিশনার দেখবেন।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিএমপি অ্যাক্ট অনুযায়ী সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি নিতে হবে। জানমালের হুমকি, আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি যাতে কিছু না ঘটে সেজন্য ডিএমপি শর্ত দিয়ে থাকে। যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শর্ত পালন করার সুযোগ কতটুকু আছে? বিবেচনা করে দেখেন। শর্ত সব মানা সম্ভব নয়। তবুও শর্ত দেওয়া হয় যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। শর্ত মানা রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক দায়িত্ব। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন মর্মেই তো শর্তসাপেক্ষে অনুমতি নেন। এখন শর্ত যদি কোনো দল না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সুযোগ আছে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিছিল-মিটিং করার জন্য অনুমতি জরুরি। এক্ষেত্রে পুলিশ মিছিলের রুট নিরাপদ ও খালি করার ব্যবস্থা করে। আবার মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুমতি লাগে। তবে, সমাবেশের জন্য অনুমতি নিতে হবে এমন সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। আবার পুলিশ যদি মনে করে সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটতে পারে তাহলে সেটা (সমাবেশ) বাতিল করে দিতে পারে।

শর্ত না মানা দলের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে সবকিছু আইন অনুযায়ী চলে না। বাস্তবতার আলোকে কিছু ব্যত্যয় ঘটে থাকে। বিধানে আছে শর্ত দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে শর্ত না মানলে ডিএমপি কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে বা বাতিল করতে পারে অথবা অনুমতি নাও দিতে পারে। তবে, পুলিশ সাধারণত এমন কিছু করে না। বড় সমাবেশ যদি পুলিশ বন্ধ করতে যায় তাহলে ঝামেলা আরও বাড়তে পারে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শর্ত সবারই মানা উচিত। শর্ত মেনেই কর্মসূচি পালন করা উচিত। শর্ত না মানলে পুলিশ যেমন ব্যবস্থা নিতে পারে, তেমনি অনুমতি না দিলে বলবে সরকারের সদিচ্ছা নেই। আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করছে, সেখানে কিছু ঘটেনি। শর্ত মেনেই সব করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেখেন বিএনপি লাঠিসোঁটা হাতে কাল পদযাত্রা কর্মসূচি করেছে। বোমাবাজি করেছে, অনেকে হতাহত হয়েছে। যারা শর্ত মেনে কর্মসূচির অনুমতি পেয়ে শর্ত মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব শর্ত মানা সম্ভব সেগুলো মেনেই আমরা সমাবেশ করি। উন্মুক্ত স্থানে চাইলেও কিছু শর্ত মানা সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা চেষ্টা করি।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আবার কীসের অনুমতি? শর্তই বা কেন? শুধু পুলিশকে অবহিত করলেই তো হয়। আর নিরাপত্তা দেওয়াই পুলিশের কাজ। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা বা শর্ত দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।

জেইউ/এসকেডি/এমএআর/