বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ দেখতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে সে বার্তা দিচ্ছে। যদিও শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে এখনও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। ইইউর প্রতিনিধিদের কাছেও নির্বাচন নিয়ে নিজেদের ‘একরোখা’ অবস্থানের কথা বলেছে দলগুলো।

নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন ইইউর ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল (স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল)। দলটিকে বলা হচ্ছে মূলত প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। কারণ, আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না আর পাঠালে কত জনবল বা কী কী দরকার পড়বে সে বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবে প্রতিনিধি দলটি।

গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এবি পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধি দলটি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে তাদের। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানকালে আরও একবার বৈঠক করারও সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইইউ প্রতিনিধিদের বলেছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বেই সম্ভব। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হলে তাতে দলটি অংশ নেবে না।

বৈঠকে ইইউকে জাতীয় পার্টির (জাপা) বার্তা, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। অন্যদিকে, নিবন্ধন বাতিল থাকা জামায়াতে ইসলামী বলেছে, নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হলে তাতে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে অর্থহীন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ইইউ প্রতিনিধি দলকে যার যার নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরেছে। আদতে সব দলই ইইউর সমর্থন চাইছে। দলগুলো যদি নিজস্ব অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে তা এখন বলা না গেলেও সেটি যে দেশের মানুষের মঙ্গল বয়ে আনবে না তার আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলো ইইউ প্রতিনিধি দলকে যার যার নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরেছে। আদতে সব দলই ইইউর সমর্থন চাইছে। দলগুলো যদি নিজস্ব অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে তা এখন বলা না গেলেও সেটি যে দেশের মানুষের মঙ্গল বয়ে আনবে না তার আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, পর্যবেক্ষক পাঠানোর একটা শর্ত হচ্ছে, বর্তমান সরকার তাদের পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানাবে কি না। আমাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, তাদের আমরা স্বাগত জানাই। ইইউ থেকে আমাদের কাছে একটা বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে যে, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে কি না? আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা সবসময় অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। এ কথাই হয়েছে। এর বাইরে বিশেষ কোনো কথা হয়নি।

কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি না বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কি না— এটা নিয়ে ইইউর কোনো বক্তব্য নেই উল্লেখ করে শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিদেশিরা এখানে কী করতে পারে? তারা এখানে এসেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছে, এরপর প্রতিবেদন তৈরি করবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ইইউ প্রতিনিধিদের বলেছি, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেব না, এটা পরিষ্কার। বিএনপি এ দেশের সবচেয়ে বড় দল। এ দেশের কোনো মানুষ সরকারের সঙ্গে নেই। অনেক আওয়ামী লীগারও আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই।’

ইইউ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠালে ক্ষতিটা কার হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে টুকুর ভাষ্য, তারা (ইইউ) সবসময় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশের মানুষকে তার ফল ভোগ করতে হবে। দেশের মানুষকে শাস্তি দিয়ে যদি আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে মানুষ এবার তার জবাব দেবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ইইউর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিদেশিরা এখন পর্যন্ত সংকট সমাধান করতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে না, সেটা অবশ্য বলা যাবে না। আমরা সমাধানের বিষয়ে আশাবাদী। এছাড়া নির্বাচনের এখনও ছয় মাস বাকি আছে।’

জাপা চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কারণ আছে। তারা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভয়ে আছে। এখন সুবিধাজনক অবস্থানে আছে সরকার। তারা প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সুবিধা মতো সাজিয়েছে এবং আরও সাজাচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেও বলছে না, বিপক্ষেও বলছে না। তারা (বিদেশিরা) বলছে সমঝোতার কথা। বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তারা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা চায়, আমরা আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সমস্যার সমাধান করি।

রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধানের পরামর্শ দেন বদিউল আলম মজুমদার। তার ভাষ্য, ‘সমঝোতা যদি না হয়, সংঘাত অনিবার্য। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সমাধানে বা সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারে তাহলে পরবর্তীতে কী হবে আমরা বলতে পারি না। তাদের ওপর নির্ভর করছে দেশের স্থিতিশীলতা। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনড় অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। সমস্যা আমাদের, সমাধানও আমাদের করতে হবে।’

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইইউ প্রতিনিধি দল সরকার ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। প্রতিনিধি দলের জানার ও বোঝার বিষয় একটাই- বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে কি না। দেখুন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ত্রুটির কথা কিন্তু সরকারও স্বীকার করছে। যখন ক্ষমতাসীন সরকার বিষয়টি স্বীকার করে, তার মানে হচ্ছে যে রাজনীতিতে বোঝাপড়া বাড়ছে। নির্বাচনের সময় সবার সহযোগিতা চাইছে সরকার। আমার মনে হয় এখন দায়িত্বটা নির্বাচন কমিশনের, সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় বের করা।

অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘যদি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখতে হয়, সেই দায়িত্ব কিন্তু নিতে হবে রাজনীতিকদেরই। তারা একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন, শত্রু হবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে, একে-অপরকে শত্রুতে পরিণত করার চেষ্টা করছে। এখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সেই সুযোগটা নিচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের যে গুরুত্ব বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আছে, বিষয়টা বাংলাদেশের নেতাদের বুঝতে হবে। তাদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা থেকে সরে আসতে হবে।’

এনআই/এএইচআর/জেএস