গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা খর্বের বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছে না প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

জাতীয় সংসদে গত ৪ জুলাই রাতে বিরোধীদের আপত্তির মুখে পাস হওয়া আরপিওর বিলের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তবে বিলটির আইনের গেজেট প্রকাশের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন সিইসি।

তিনি জানিয়েছিলেন, আরপিও সংশোধনে তাদের ক্ষমতা কমেনি বরং বেড়েছে। নতুন ধারা আরপিও -তে যুক্ত হওয়ায় অনেক বিষয়ে ক্ষমতা বেড়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমে ইসির ক্ষমতা কমার বিষয়টি সিইসি মানতে চাননি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নিজের অবস্থান শক্তপোক্ত করতে এবং আরপিওর বিষয়ে আরও স্পষ্ট করতে এবার সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছে আউয়াল কমিশন নেতৃত্বাধীন কমিশন।

ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০ জুলাই প্রায় ২৫ জন নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরপিও সংশোধন নিয়ে সংলাপ করবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে বিশেষজ্ঞদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলমের স্বাক্ষরিত চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে আরপিও নিয়ে সংলাপের চিঠি পেয়েছেন বলে ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।

চিঠিতে ইসি উল্লেখ করেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর সংশোধনী ‘জনপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) বিল ২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হয়ে আইন হয়েছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য অংশীজনদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনা-সমালোচনা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃতপক্ষে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) নিয়ে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে; যা দূরীভূত করা প্রয়োজন। এজন্য সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত, পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

ইসি চিঠিতে জানায়, নির্বাচন কমিশন বিশ্বাস করে যে, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ সংশ্লিষ্ট সবার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এরই অংশ হিসেবে সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের লক্ষ্যে আগামী ২০ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টায় নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন। এসময় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা সভায় উপস্থিত থাকবেন।

আরপিওর সংশোধনী অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর কোনো আসনের পুরো ফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যে-সব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) ভোটকেন্দ্রের ফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে তা বাতিল করে ইসি ওইসব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে।

আরপিও সংশোধনের আগে, অনিয়ম বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে তারা আইনানুগ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে তাদের ভোট বন্ধের ক্ষমতা ছিল। তবে আরপিও সংশোধনের ফলে সেই ক্ষমতা কিছুটা কমেছে।  

জাতীয় সংসদে আরপিওর বিল পাসের আগে “নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও খর্ব হবে” বলে জানিয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বিবৃতিতে জানায়, এটি হচ্ছে “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা”। প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘনের কারণে যৌক্তিক বিবেচিত হলে যেকোনো নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন বাতিলের যে ক্ষমতা বিদ্যমান আইনে রয়েছে, তা কেড়ে নেওয়া হবে। তাই সংশোধনী প্রস্তাবটি বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিল টিআইবি। এর বাইরেও গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো উচিত। অথচ জাতীয় নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যেন ততই কমছে।

আরপিও সংশোধন ও ইসির সংলাপের বিষয়ে প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন আইনের ছাত্র এবং তিনি আইন সচিব ছিলেন। এ কারণে তিনি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। দুটি শব্দের ক্ষেত্রে উনি উনার ব্যাখ্যা পরিষ্কার করেছেন, নির্বাচন ও পোল। এই দুইটার মধ্যে নির্বাচন শব্দটির ব্যাপকতা অনেক। অন্যদিকে, সমার্থক শব্দ পোল এর পরিধি ততটা বিস্তৃত নয়।’

তিনি বলেন, ‘তবে বিষয়টা হচ্ছে গাইবান্ধার উপনির্বাচনটা যেভাবে বন্ধ হয়েছে, এরকম ঘটনা নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে দ্বিতীয় আর একটি নেই। একটা পুরো আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করে দেওয়ার মতো যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা অভাবিতপূর্ব বা পূর্বে কোন নজির নাই। আমার জানামতে, সন্দ্বীপে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে একবার এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। কারণ, নির্বাচনের দিন ওখানে একজন লোকও ভোট দিতে আসেনি। যার ফলে ওখানে নির্বাচন কমিশন পুরো ভোট বাতিল করেছিল। সেই অর্থে গাইবান্ধার ভোট বন্ধ করে দেওয়া নজিরবিহীন ছিল।’  

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘ভবিষ্যতে তাত্ত্বিক বিবেচনায় যদি ৩০০ আসনের নির্বাচনই তারা বাতিল করে দেন, তাহলেও তো ভয়ংকর একটা সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ হচ্ছে সব সম্ভবের দেশ। যেমন মনে করেন, আমরা বোতল থেকে জিনটা ছেড়ে দিলাম এবং সে বোতলের মালিকের টুটি চেপে ধরলো। তখন আমরা যাবো কোথায়। সেইসব বিবেচনাও হয়ত এখানে কাজ করেছে। যেটা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে বলা সঙ্গত নয়, স্বাভাবিকও নয় বা সম্ভবও নয়। আমাদের আসলে একটা ব্যালেন্স রাখতে হবে। বিষয়টা হচ্ছে কমিশন যেন ফ্যান্টাসটাইন (চমৎকার) আচরণ না করে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে কমিশন যাতে শাসক দলের আজ্ঞাবহ না হয়ে কাজ করে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। এইসব জায়গায় ব্যালেন্স রাখতে হবে। আরপিও সংশোধনীতে এইরকম একটা ব্যালেন্স কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।’

পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি নিশ্চয় জানেন যে, পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মূলত জুডিসিয়ারিকে ব্যবহার করেছে সরকারকে সরানো জন্য। আমাদের এখানে সেই জাতীয় ভূমিকা কমিশন যদি করে বসে, তাহলেও তো সেই সুযোগ রাখা ঠিক হবে না। এইসব বিবেচনাও হয়ত কাজ করেছে শাসক দলের নীতিনির্ধারকদের। যার ফলেই এই সংশোধন নিয়ে আসা হয়েছে বলে আমার ধারণা।’

এসআর/এসএম