দেশের ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কন্যা শিশুদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার। যা মোট বাল্যবিয়ের মোট ৭২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ৫৬ শতাংশ অভিভাবক বাল্যবিয়ের আইন সম্পর্কে অবগত হলে আইন অমান্য করে নানাভাবে তাদের কন্যা শিশুর বিয়ে দিয়েছেন। এ বিয়েগুলোর মধ্যে ৫৮ শতাংশ বিয়েই হয়েছে রেজিস্ট্রি ছাড়া।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ‘বাল্যবিয়ের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত’ বিষয়ক এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে এ সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করেন মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী ও আইনজীবী অ্যাড. ফাতেমা খাতুন।

সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপনের সময় বলা হয়, ৮টি বিভাগের ৩৭টি জেলা এবং সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ২০৬০ জনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাল্যবিয়ে দেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্তের হার সবচেয়ে বেশি। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও বাল্যবিয়ের হার প্রায় এক চতুর্থাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে শিক্ষাও এক্ষেত্রে বড় প্রভাব বিস্তার করে। বাল্যবিয়ে দেওয়া অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ (২৬০ জন) নিরক্ষর, ৪১ শতাংশ (৩৪৭ জন) অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, ২৬ শতাংশ (২১৭জন) স্বল্প শিক্ষিত ও শিক্ষিত ৪ শতাংশ (৩৩ জন)।

জরিপকালে ৩৬ শতাংশ ম্যারেজ রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, সমাজে বাল্যবিয়ের হার মাত্র ১০ শতাংশ। মাত্র ৩ শতাংশ ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বলেছেন দেশে বাল্যবিয়ের হার ৫০ শতাংশ।

সমীক্ষায় বাল্যবিয়ের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত হিসেবে কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কন্যার প্রতি দায়িত্ব পালন, বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুর ওপর আসা অভিঘাত সারাজীবন বয়ে বেড়ানো, মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, স্বাস্থ্য অধিকার ক্ষুণ্ন এবং জীবনভর নির্যাতনের শিকার হতে থাকা, বাল্যবিয়ে বিষয়ক তথ্যের অভাব এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কাজের পরিবীক্ষণ না করা, মিথ্যা সনদপত্র প্রদান করা, বাল্যবিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা এবং জবাবদিহিতা সর্বোপরি সুশাসনের অভাব, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার বড় প্রতিফলন, আইন থাকা সত্ত্বেও এই দায়িত্বহীনতা অপরাধ হিসেবে গণ্য না হওয়াকে তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আব্দুল আজিজ বলেন, অনেক আইন থাকলেও বাস্তবে তা প্রয়োগ করা যায় না। গ্রামে অত্যন্ত দারিদ্র্যদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। বংশানুক্রমে কাজীর ছেলে কাজী হয়, এটা বন্ধ করা গেলে বাল্যবিয়ে বন্ধে সুফল আসত। কাজীরা তাদের সুযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এজন্য প্রশাসনকে জোরালো ভূমিকা পালনে জনপ্রতিনিধিদের তৎপর হতে হবে। কিশোরী ক্লাবগুলোর মাধ্যমে বাল্যবিয়ে বন্ধে কিশোরীদের সচেতন করতে হবে। তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে কিশোর-কিশোরী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ও সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানান। 

অনুষ্ঠানে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাল্যবিয়ের প্রবণতায় জেলাভিত্তিক কোনো পার্থক্য আছে কিনা এটা মূল রিপোর্টে আনা যেতে পারে। এছাড়া পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিয়ে বাড়ছে– এটাকে জনপ্রতিনিধিদের অজুহাত হিসেবে দেখানো বন্ধ করতে হবে।

বাল্যবিয়ে দিলে কন্যা উপবৃত্তি পাবে না এমন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কিশোরী ক্লাব মনিটরিং করতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি দূর করতে সরকারি সংস্থাকে উদ্যোগ নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

আলোচকদের মধ্যে বিআইজিডির প্র্যাকটিস অ্যান্ড হেড অব জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন ক্লাস্টার এর সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতান; কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর রওনক জাহান ও জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি বক্তব্য রাখেন।

তারা বলেন, এভিডেন্স বেসড অ্যাডভোকেসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমীক্ষায় আসা তথ্য গুলো বাস্তবসম্মত। কোভিডের পর ঝরে পড়া শিশুদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ কতটা কার্যকর তা এখন দেখতে হবে; দারিদ্র্যতাই বিয়ের মূল কারণ কি না দেখতে হবে; জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে; কাজীদের মানসিকতা পরিবর্তনে আরো কাজ করতে হবে; কীভাবে একজন কিশোরীর জন্য বিনিয়োগ করলে উপকার হবে সে বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে, তাদের প্রায়োরিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি পর্যায় থেকে বাল্যবিয়ের কথা কম বলা হচ্ছে। এখানে তথ্যগত বিভ্রান্তি রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেকাংশে জড়িত, এমতাবস্থায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিং করার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট, সরকারের সঙ্গে কাঠামোগতভাবে সমন্বয় করতে হবে; সরকারি তথ্য হালনাগাদ করতে হবে এবং এর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে; গণমাধ্যমকে বাল্যবিয়ের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে হবে; যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকতে হবে; সিদ্ধান্তগ্রহণ বিষয়ে কন্যা শিশুদের সুযোগ দিতে হবে।

সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাল্যবিয়ে নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহুমুখী পদক্ষেপ থাকা স্বত্বেও কেন বাল্যবিয়ে বাড়ছে এবং বাল্যবিয়ের কারণে তৈরি হওয়া অভিঘাতগুলোকে সমাজ কীভাবে দেখছে তা পর্যালোচনার জন্য আজকের সভার আয়োজন।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোরীরা ভূমিকা পালন করছে, যা অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষার মান উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাকে পণ্য হওয়া থেকে মুক্ত করে একটি মানবিক শিক্ষা কিশোর কিশোরীদের দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে তার সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া জোরালো ভূমিকা পালন করে। নারীর রাজনীতিতে অধিকার, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার এবং নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম বন্ধ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই তিনটি বিষয় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আবশ্যক।

জেইউ/কেএ