রাজধানীর সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় নবজাতক ও এক মায়ের মৃত্যুর অভিযোগের মধ্যেই আরেকটি বড় হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।

গ্রিন রোডের ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের অবহেলায় এক নারী রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।  

স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির পর কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমনকি পর্যবেক্ষণ ছাড়াই রোগীকে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। পাকস্থলীর টিউমার অপারেশন করা হয়। এর দুদিন পর রোগীর রক্তক্ষরণ শুরু হয়।

আরও পড়ুন >> সেন্ট্রাল হসপিটাল আমার নাম ব্যবহার করে অনিয়ম করেছে : ডা. সংযুক্তা

হাসপাতালের দায়িত্বরত হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. আখতার আহমেদ শুভ কয়েক দিন পর আবারও ওই রোগীর অপারেশন করেন। তাতেও বন্ধ হয়নি রক্তক্ষরণ। 

গত ১৭ মে পাকস্থলীতে টিউমার অপারেশন করার জন্য ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভর্তি করা হয় হাসিনা বেগমকে। সেখানে ডা. আখতার আহমেদ শুভর তত্ত্বাবধানে হাসিনা বেগমকে ভর্তি করা হলেও তিনি নিজে রোগীকে দেখেননি। আগের করা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ১৮ মে হাসিনা বেগমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে টিউমার অপসারণের ব্যবস্থা করেন। অপারেশনের পর দুদিন না যেতেই রোগীর কাটা জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এজন্য তাকে ১৩০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। তারপরও রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। ২৯ জুন রোগীর দ্বিতীয় অপারেশন করেন ডা. আখতার আহমেদ শুভ। এতেও রোগীর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি

কোনো উপায় না পেয়ে শেষে হাসপাতাল থেকে রোগীকে রিলিজ করতে বলা হয় স্বজনদের। তবে, স্বজনরা রাজি না হওয়ায় কেবিন ম্যানেজ করে খোদ চিকিৎসকই হাসিনা বেগম নামের ওই মুমূর্ষু রোগীকে পাঠিয়ে দেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে গত ১৭ জুন ভোরে মারা যান ওই রোগী।

রোগীর মৃত্যুর পর ওই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা এবং কর্তব্যরত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তুলে মৃত রোগীর স্বামী মো. রাসেল রাজধানীর কলাবাগান থানায় মামলা করতে চাইলে তা গ্রহণ করেনি পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, জিডি হিসেবেও প্রথমে গ্রহণ করা হয়নি। পরে লিখিত অভিযোগ আকারে সেটি গ্রহণ করা হয়। তবে, ১৭ জুন ওই রোগীর মৃত্যুর পর আজ সকালে (২০ জুন) সেই অভিযোগ জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করার কথা জানায় কলাবাগান থানা পুলিশ।

আরও পড়ুন >> সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা : সেই আঁখি আর নেই

গত ১৭ মে পাকস্থলীতে টিউমার অপারেশন করার জন্য ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভর্তি করা হয় হাসিনা বেগমকে। সেখানে ডা. আখতার আহমেদ শুভর তত্ত্বাবধানে হাসিনা বেগমকে ভর্তি করা হলেও তিনি নিজে রোগীকে দেখেননি। আগের করা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ১৮ মে হাসিনা বেগমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে টিউমার অপসারণের ব্যবস্থা করেন। অপারেশনের পর দুদিন না যেতেই রোগীর কাটা জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এজন্য তাকে ১৩০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। তারপরও রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। ২৯ জুন রোগীর দ্বিতীয় অপারেশন করেন ডা. আখতার আহমেদ শুভ। এতেও রোগীর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

দ্বিতীয় অপারশেনরে পরও রোগীর উন্নতি না হলে ১২ জুন তাকে নেওয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসিনার স্বামী রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১২ জুন সেখানে নেওয়ার পর অপারেশনের জায়গা, নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে অনর্গল রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ১৪ জুন ডাক্তার সাক্ষাৎ করতে আসার কথা বলেও আসেননি। অনেক চেষ্টা করেও সেখানে আইসিইউ ম্যানেজ করতে পারিনি। ১৫ জুন ভোরে মারা যায় আমার স্ত্রী।

‘আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার দুদিন পর ডাক্তার ফোন করে বলেন, আমাদের কোনো ক্ষোভ বা রাগ আছে কি না? তিনিও নাকি আমাদের মতো সমব্যথী। চিকিৎসকের খামখেয়ালিপনা ছিল, অবহেলা ছিল, চিকিৎসায় ভুল ছিল। সেজন্য আমার স্ত্রী মারা গেছে। এজন্য আমি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে থানায় লিখিত অভিযোগ করি। আমি চাই এটার তদন্ত হোক, দোষীদের শাস্তি হোক। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।’

আরও পড়ুন >> ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু, বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না স্পেশালাইজড হাসপাতালের

মৃত হাসিনা বেগমের ভাই জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বোনের অসুস্থতার পর কদমতলী ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করি। পরীক্ষায় জানা যায় তার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। পরে গ্রিনরোড ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে পরীক্ষা করায়। সেখানে পাকস্থলীতে টিউমার ধরা পড়ে। তাদের পরামর্শ ও যোগাযোগের ভিত্তিতে বোনকে (হাসিনা বেগম) ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভর্তি করায়। বোনের চিকিৎসার মূল দায়িত্বে ছিলেন ডা. আখতার আহমেদ শুভ।’

‘ডাক্তার কাগজপত্র দেখেই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। রোগীর সঙ্গে দেখা কিংবা কথাও বলেননি। ভর্তির পরদিনই সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে অপারেশন করান। ডাক্তার বলেছিলেন, আড়াই লাখ টাকা খরচ হবে। কিন্তু সেখানে ১৬ লাখ টাকা খরচ করেও বোনকে বাঁচাতে পারিনি।’

জাহিদ বলেন, ‘ডাক্তার খামখেয়ালিপনা করেছেন। শুধুমাত্র টাকার জন্য তিনি অপারেশন করেছেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বোন আমার মারা গেছে। অপারেশনের পর ডাক্তার আর কোনোভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারেননি। ভালো হওয়ার পর উল্টো অবস্থার অবনতি হয়। দ্বিতীয়বার অপারেশনের সময় তিনি বোর্ড মিটিং করেননি, অন্য চিকিৎসকের পরামর্শও নেননি। দ্বিতীয় অপারেশন করেও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। নাক, মুখ, পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তক্ষরণ চলতে থাকে।’

যা বলছে পুলিশ

যোগাযোগ করা হলে কলাবাগান থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অভিযোগ উঠলেই মামলা হয়, এমন নয়। মৃত রোগীর স্বজনরা মামলা করতে চেয়েছিলেন। আমরা বলেছি, লিখিত অভিযোগ দিয়ে যান। যদি তদন্ত করে মনে হয় চিকিৎসায় অবহেলা ছিল তাহলে আমরা মামলা নেব। গত ১৭ জুন তারা একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে যান। মঙ্গলবার (২০ জুন) সেটি জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতামতের ভিত্তিতে অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।’

‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা লাগতে পারে। তদন্তে দায় পেলে অবশ্যই আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

অভিযুক্ত চিকিৎসক আখতার আহমেদ শুভ / ছবি- সংগৃহীত

মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কলাবাগান থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আবু জাফর মো. মাহফুজুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জিডি হয়েছে। তদন্ত চলছে। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। তারা তদন্তে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছেন। অভিযোগকারীকে তলব করা হয়েছে। তার কাছ থেকে আমরা বিস্তারিত শুনব।’

সবকিছু জানিয়েই অপারেশন করেছি : ডা. আখতার আহমেদ শুভ

যে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলেছেন রোগীর স্বজনরা, সেই আখতার আহমেদ শুভ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি আমার পেশাগত দক্ষতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। তার আসলে পাকস্থলীতে টিউমার নয়, প্যানক্রিয়াটাইটিস ছিল। ক্যান্সার হয়ে গিয়েছিল। সেকেন্ড স্টেজে ছিল। তাই অপারেশন করা। এ ধরনের রোগীদের অপারেশনের পর সাধারণত ব্লিডিং হয়। এটা শুধু এখানে নয়, আমেরিকাতেও হয়।’

তার দাবি, ‘সবকিছু জানিয়েই অপারেশন করেছি। এখন তারা কেন অভিযোগ তুলছেন, বুঝতে পারছি না। থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। এখন তদন্তে আমি সহযোগিতা করব। আমি জানি আমার কোনো অবহেলা বা দায় ছিল না।’

ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অমিতাভ ভট্টচার্য্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলাবাগান থানায় একটি জিডি হয়েছে শুনেছি। রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। বিষয়টি আমাদের কাছে অফিসিয়ালি এখনও আসেনি। আসুক, তারপর আমরা প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত বা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করব।

জেইউ/এনএফ