চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস
কাস্টমের সার্ভারে ঢোকা রায়হান জলের কত গভীরের মাছ?
# মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানির দুই মামলার আসামি রায়হান
# কয়েক দফা রিমান্ডে আনা হলেও মুখ খোলেননি
# কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় তদন্তে বিপাকে পিবিআই
মেহেদী হাসান রায়হান (২৯)। চট্টগ্রামের একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট-এ চাকরি করেন। বিনা অনুমতিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সার্ভার রুমে অনুপ্রবেশ করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তবে ঘটনা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনোকিছু স্বীকার না করায় তাকে নিয়ে রহস্য ও চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে।
সার্ভারে ঢোকার মামলায় জামিন পেয়ে এখন অন্য মামলায় কারাগারে আছেন রায়হান। কেন তিনি সার্ভার রুমে ঢুকেছিলেন কিংবা আদৌ তিনি সেখানে ঢুকেছিলেন কি না তা নিয়ে পরিষ্কার হতে পারছে না পুলিশ। সার্ভারে ঢোকার জন্য ধরা হলেও এখন কাস্টম কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সার্ভারে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি!
বিজ্ঞাপন
এদিকে আটক হওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়া দুই কনটেইনার মদ জব্দের (নারায়ণগঞ্জে) ঘটনায় রায়হানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ হওয়া আরেক কনটেইনার মদ আমদানির ক্ষেত্রেও তার নাম উঠে এসেছে।
দুই যুবকের মধ্যে একজন কাস্টম হাউসের নিচতলায় আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সফটওয়্যার কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে ঢুকে পড়েন। অন্যজন কক্ষের বাইরে অবস্থান করে পাহারা দেন। পরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সহায়তায় দুই যুবককে আটক করেন কাস্টম কর্মকর্তারা
এতসব ঘটনায় জড়িত মেহেদি হাসান রায়হান কোনোভাবেই কিছু বলছেন না পুলিশকে। তাকে নিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়েও তার মুখ খুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন রায়হানের বিষয়টা সরল নয়, এখানে অনেক যদি-কিন্তুর প্যাঁচ আছে। দু-একজন কর্মকর্তা মনে করছেন রায়হান একটা গভীর জলের মাছ। তার সঙ্গে আরও অনেকে ওই জলে ডুব দিয়ে আছে। সার্ভার রুমে ঢোকার মামলাটি প্রথমে বন্দর থানার হাতে থাকলেও বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, রায়হানের ঘটনা তদন্তে নেমে তারা প্রথমে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের সে ফুটেজ দিচ্ছে না। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানার চেষ্টা করছেন, অভিযুক্ত রায়হান কী কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমসে এসেছিলেন, তার উদ্দেশ্য কী ছিল? তিনি কি আগের মতো অবৈধ প্রক্রিয়ায় কোনো মালামাল খালাস করতে এসেছিলেন? সিসিটিভি ফুটেজ কেন পাওয়া যাচ্ছে না, সেটি কি নষ্ট করা হয়েছে? আগে অবৈধভাবে খালাস হওয়া মদের চালানের লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রায়হানকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না?
কী ঘটেছিল সেদিন?
দেশের সবচেয়ে বড় শুল্ক-কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। এখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে সরকার। এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়। এসব বিল অব এন্ট্রি শুল্কায়ন সংক্রান্ত অ্যাসাকুইডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের কার্যক্রম অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে হয়ে থাকে। এজন্য কক্ষটি খুবই স্পর্শকাতর। এই কক্ষে গত ফেব্রুয়ারিতে দুই যুবকের অনুপ্রবেশের খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কাস্টমসের স্পর্শকাতর এরিয়া সফটওয়্যার কক্ষ থেকে দুই যুবককে আটক করেন আনসার সদস্যরা। তারা হলেন– মো. মেহেদী হাসান ওরফে রায়হান (২৯) ও খায়েজ আহমেদ (২৯)। ওই সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাঁচটি মোবাইল, দুটি চাবির ছড়া, ওই কক্ষের একটি তালা, একটি ল্যাপটপ, একটি ইউএসবি ক্যাবলের সঙ্গে চিপস, একটি রাউটার, দুটি ইউএসবি হাব ও পাঁচ ইঞ্চি সাইজের একটি মাস্টার চাবি জব্দ করা হয়। এরপর তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টম হাউস সূত্রে জানা যায়, দুই যুবকের মধ্যে একজন কাস্টম হাউসের নিচতলায় আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সফটওয়্যার কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে ঢুকে পড়েন। এ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি কমিশনার নুরুন নাহার লিলি। অভিযুক্তদের অন্যজন কক্ষের বাইরে অবস্থান করে পাহারা দেন। পরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সহায়তায় দুই যুবককে আটক করেন কাস্টম কর্মকর্তারা।
আটকের পর অভিযুক্তরা জানান, তারা ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম এসে কাস্টম হাউসে ঢুকেছেন। তবে কী কারণে কাস্টম হাউসে ঢুকেছেন তার সন্তোষজনক বা বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দেননি।
এখনো অন্ধকারে পিবিআই
অনুপ্রবেশের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। এ মামলার দুই আসামি জামিনে রয়েছেন। যদিও অন্য মামলা থাকার কারণে আসামি রায়হান কারাগারে আছেন।
তিনি বলেন, তাদের আমরা এখনো অফিসিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। তবে মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানির একটি মামলায় রায়হানকে রিমান্ডে নিয়ে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়েছিল। তখন তাকে অনুপ্রবেশের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মুখ খোলেননি।
আমদানিকারক পৃথক হলেও চালানগুলো খালাসের দায়িত্বে ছিলেন জাফর আহমেদ নামে এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। তার ছেলের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক রয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন
তিনি বলেন, ঘটনার দিনের সিসিটিভি ফুটেজের জন্য আমরা আদালতের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছি। তারপরও পাওয়া যায়নি। জব্দ হওয়া ডিভাইস পরীক্ষার জন্য আদালতে অনুমতি চেয়েছি। এখনো অনুমতি মেলেনি।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার (এসপি) নাইমা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক আসামিকে অন্য মামলায় রিমান্ডে আনা হয়েছিল। তিনি মুখ খুলছেন না। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মামলাটির আদ্যোপান্ত বের করার চেষ্টা করছি।
অবৈধ চালান খালাস চক্র ও রায়হান
গত বছরের ২৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা থেকে র্যাবের সহায়তায় দুই কনটেইনার মদ জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। চালানটি আনা হয়েছিল কুমিল্লা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে। এরপর ২৪ জুলাই বন্দর থেকে এক কনটেইনার মদ জব্দ করা হয়। এটি আমদানি করা হয় উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিমিটেডের নামে।
পরদিন ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুই কনটেইনার মদ জব্দ করা হয়। চালান দুটি আনা হয় উত্তরা ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান ডং জিন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কোম্পানি ও মোংলা ইপিজেডের ভিআইপি ইন্ড্রাস্ট্রিজ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে।
আমদানিকারক পৃথক হলেও চালানগুলো খালাসের দায়িত্বে ছিলেন জাফর আহমেদ নামে এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। তার ছেলের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক রয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন।
ওই সময়ে অবৈধভাবে মাদক আমদানির বিষয়ে তথ্য দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) কাস্টমস শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) রাশেদুর রহমান। চালান আটকের পর তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নগরের ইপিজেড থানায় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।
কাস্টম হাউসের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
চট্টগ্রাম কাস্টমসে বহিরাগত অনুপ্রবেশের ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও বহিরাগত কয়েকজনকে হাতেনাতে আটক করেছিল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। যদিও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একইসঙ্গে বারবার বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে আটক হয়েছিলেন মো. আজগর আলী ও মো. ওবায়দুন্নবী নামে দুজন। বহিরাগত হয়েও তারা কাস্টমসের একটি শাখায় কাজ করতেন। এছাড়া সবশেষ গত ২৫ মে প্রসেনজিৎ দাশ নামে এক বহিরাগতকে আটক করেন কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রসেনজিৎ নিজেকে কাস্টমসের এক কর্মচারীর আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। ওই আত্মীয় প্রসেনজিতকে পারিশ্রমিক দিতেন বলে জানান তিনি।
কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, বহিরাগতরাই একসময় এখানে সর্বেসর্বা হয়ে যান। তাদের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনসহ নানা অনিয়ম হয়। নানা সময় ঝটিকা অভিযানে কেউ কেউ ধরা পড়লেও বেশির ভাগ অধরা থেকে যায়। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ফোন ধরেন না কর্মকর্তারা
সার্বিক বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান ও ডেপুটি কমিশনার মুহাম্মদ মাহফুজ আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা দুজনই ঢাকা পোস্টের ফোন ধরেননি।
এমআর/এসএসএইচ/জেএস