শ্রমিক লীগ নেতা অপু হত্যা
অর্পার মলিন মুখ, লাব্বাইক জানে না বাবা নেই
শিশু লাব্বাইকের চোখ শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবাকে। তাকিয়ে থাকছে জানালার ধারে। কখনো দৌড়ে নিচে নামছে। বাসার কাছেই বাবার অফিস। হাত নাড়িয়ে দেখা দিতেন বাবা অপু ইসলাম। কিন্তু দুই দিন বাবার দেখা নেই। বাসার জানালার ধারেই দাঁড়িয়ে বাবার খোঁজ করছে অবুঝ লাব্বাইক। কিন্তু বাবা ফেরে না, দেখাও মিলছে না সারাজীবনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাবা অপুর।
রোববার (১১ জুন) দুপুরে রাজধানীর সাতারকুল ব্রিজের পাশে উত্তরপাড়া মসজিদ-সংলগ্ন অপু ইসলামের বাসায় গিয়ে তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। এসময় অপুর শিশু সন্তান লাব্বাইকের চোখে মুখে ছিল বাবাকে খুঁজে ফেরার ছবি।
বিজ্ঞাপন
শিশু লাব্বাইকের মা ও নিহত অপুর স্ত্রী শাহেলা বেগম বলেন, আমার ছোট বাচ্চাটা বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না। বার বার বলছে, বাবার কাছে যাব! আমি কোথায় নিয়ে যাই। আমার স্বামীকে এখন কে ফিরিয়ে দেবে? ওকে বোঝানো যাচ্ছে না বাবা আর ফিরবে না! এটা খুব কষ্টের।
আহাজারি করে তিনি বলেন, মেয়েটা বুঝেছে বাবা মারা গেছে, কিন্তু চোখ থেকে ঝরছে না পানি। মলিন মুখে হারিয়ে গেছে খিলখিল হাসিটাও, এই স্তব্ধতা বড় পীড়াদায়ক।
রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন সাঁতারকুলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মীমাংসার কথা বলে গত শুক্রবার (৯ জুন) রাতে বাসায় ডেকে মারধরের পর অপু ইসলামকে (৩৫) লিফটের ফাঁকা জায়গা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অপু স্থানীয় ৪১ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
অপু ইসলামকে পিটিয়ে ও ছাদ থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগে শনিবার (১০ জুন) দিবাগত রাতে তার বড় ভাই খোরশেদ বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৯।
ওই মামলার এজাহারভুক্ত ও অপু হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় সাঁতারকুল স্কুলের দুই শিক্ষক শাহাদাৎ হোসেন (৪৫), সাবেক ব্যাংকার মোরশেদ হোসেন (৫৬) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী হামিদুল ইসলাম (৩৭), সনেট সরকার (২২), মেহেদী হাসান (২২) এবং শাহজাহান কবির (২৩)কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আজ তাদের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, অপুর ইট-বালির ব্যবসা, রয়েছে পিকআপ, মাছের ঘের। আর নিজস্ব বাসা ছাড়াও ভাড়ায় রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট। এগারো বছর আগে সাঁতারকুলের স্থায়ী বাসিন্দা অপু এলাকাতেই বিয়ে করেন। স্ত্রী শাহেলা বেগম (৩২), দুই সন্তান অর্পা ইসলাম(১১) ও লাব্বাইক(৩) ছাড়াও বাসায় থাকেন বৃদ্ধা মা রহিমা খাতুন (৭০)।
রোববার দুপুরে রাজধানীর সাঁতারকুলে অপুর বাসায় গিয়ে কথা হয় মা রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছি। অনেক কষ্টে দুই সন্তানকে মানুষ করেছি। আজ সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত। ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য গুছিয়ে নিয়েছে। আজকে ওরা আমার ছোট ছেলেটাকে মেরে ফেলল। আমার নাতি-নাতনি দুইটারেই এতিম করে ফেলল। আমি ওদের বিচার চাই।
তিনি বলেন, মা বেঁচে থাকতে সন্তানের মৃত্যু সহ্য করা যায় না। এভাবে যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, কোনো স্ত্রীর আহাজারি করতে না হয়, আর কোনো সন্তানকে অল্প বয়সে এতিম হতে না হয়।
স্ত্রী শাহেলা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল অপুর। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলত। রাজনীতি করার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশত অপু। কখনো শুনিনি কারো সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব হয়েছে। জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল, সবাই অপুর জন্য কেঁদেছে।
শাহেলা বেগম বলেন, ‘এই বাচ্চাদের নিয়া আমি কী করুম, আমার তো সব নিয়া নিলো! বাচ্চা দুইটা নিয়া আমি কই যামু! আমার গোছানো সংসার শ্যাষ, তছনয় হয়া গেলো।’
স্বামীর সঙ্গে দিনের স্মৃতিচারণা করে শাহেলা বলেন, ‘ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে আমাকে ভিডিও কল করেছিল। জানালা দিয়া অফিস দেখা যায়। সেখানে তাকাতে বলে। হাত নাড়িয়ে বাচ্চার সঙ্গে কথাও বলে। ছেলে লাব্বাইককে ওর কাছে পাঠায় দিই। এর আধা ঘণ্টা পর বাচ্চাকে পাঠায় দেয় বাসায়। এর কিছুক্ষণ পরই শুনি আমার স্বামী ছাদ থেকেই পইড়া আর নাই। পরে শুনি আমগো ড্রাইভার শাকিলকে ফোন করছিল, বলছিল আমারে আটকায় রাখছে, তোরা আমারে বাঁচা।’
‘আমার টাকা-পয়সার অভাব নাই। সব আছে কিন্তু আমার স্বামী নাই। যারা আমার স্বামীকে মারছে, আমার বাচ্চা দুইডারে এতিম বানাইছে, কোনো বিচার দরকার নাই। আমি ওদের ফাঁসি চাই। আমার স্বামীরে মাইরা ওরা আমার দুনিয়া অন্ধকার কইরা দিছে, আমার স্বামী একটা দিনও নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও থাকত না। সেই কিনা আর ফিইরা আইল না। একলা ঘরে শুইয়া পড়লো যেখানে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া, দেখানোর সুযোগ নাই।’
অপুকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে ঘটনার বিবরণ দিয়ে খালাতো ভাই দিপু হাসান বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে অপু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। বৃষ্টির কারণে রাস্তার ডান পাশে পানি জমে ছিল। কে কোন পাশ দিয়ে যাবে সেটা নিয়ে তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ হয় অপুর।
পরে মীমাংসার কথা বলে বাসায় ডেকে নেয় ওই ভবনের একাংশের মালিক শাহাদাত। সেখানে রাতে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাকে ধরে তাদের ভাড়া বাসার সাততলার ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ব্যাপক মারধর করে। একপর্যায়ে ভবনের লিফটের জন্য রাখা ফাঁকা জায়গা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দেয় (লিফট এখনো যুক্ত করা হয়নি)। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক অপুকে মৃত ঘোষণা করে।
মারধরে হত্যা, পরে নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ স্বজনদের
অপুর পরিবার ও স্বজনরা বলছেন, অপুকে মীমাংসার কথা বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কথা কাটাকাটির মধ্যে মারধর করে ঘর থেকে বের করে লিফটের জন্য রাখা ফাঁকা জায়গা নিয়ে সপ্তম তলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে অপুর মামাতো ভাই আকাশ ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মৃত্যুর পর জেনেছি অপু ভাইয়ের পা ভেঙে গেছে। পাঁজরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, চোখে মারধরের রক্তাক্ত ক্ষত ছিল। উপর থেকে পড়লে চোখে সাধারণত ক্ষত হয় না। ঘটনার পরপরই ওই ভবনটির সপ্তম তলার রুমের ভেতরে জানালার পর্দা, চেয়ার টেবিল সব ভাঙা দেখেছি। ধারণা করছি সেখানে মারামারি হয়েছে, ভাইকে আগেই মারধর করে হত্যার পর নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যাচেলর বাসা থেকে বের হতেই সিঁড়ি। অথচ অন্তত ১০ ফিট দূরে লিফটের জায়গা। সেখান থেকে ফেলে দেওয়াটা হত্যার উদ্দেশ্যেই মনে করি।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপু সাঁতারকুল এলাকার বাসিন্দা। তিনি ৪১ নং ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে এ হত্যার ঘটনার পর আমরা মোট ১৩ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মামলায় এজহারভুক্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আজ রোববার (১১ জুন) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত সবাইকে দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানার চেষ্টা করা হবে হত্যার নেপথ্যের কারণ। আরও কেউ জড়িত ছিল কিনা এবং হত্যার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।
জেইউ/এসকেডি