সাভারের জিরানী থেকে মা-বাবাসহ পরিবারের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (৮ জুন) জাতীয় চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিল ছোট্ট শিশু সাইফ হাসান। স্বজনদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় আনন্দ করতে এসে হায়েনার কামড়ে হাতের কব্জি হারিয়ে এখন বিষাদে পুড়ছে তার পরিবার। কে জানত এই চিড়িয়াখানায় যাওয়ায় শিশু সাইফের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে!

শিশুটি বর্তমানে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, শিশুটির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত নয় সে।

এদিকে হাত হারিয়ে পঙ্গু হওয়া শিশু সাইফের পরিবার বলছে, চিড়িয়াখানায় যথেষ্ট নিরাপত্তাহীনতার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় শিশুটির ভবিষ্যত জীবন ও কর্মের নিরাপত্তা নিতে সরকার এবং চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে চিড়িয়াখানায় ঘোরার ফাঁকে মায়ের হাত ফসকে হায়েনার খাঁচার কাছে চলে যায় শিশু সাইফ। এরপর তার হাত খাঁচার ভেতর ঢুকিয়ে দিলে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। মুহূর্তেই খাঁচার ভেতরে থাকা হায়েনা খামছে ধরে তার ডান হাত। তখন তার চিৎকারে ছুটে আসে নানা, মা ও স্বজনরা। ততক্ষণে শিশু সাঈদের অর্ধেক ডান হাত হায়েনার মুখের ভেতর। এরপর তারা নানা জোরজবরদস্তি করে হাত ছাড়িয়ে নিলেও কব্জি পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়।

মায়ের মুখে সন্তানের কব্জি হারানোর বর্ণনা
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শিশু সাইফের মা শিউলি আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার আমরা চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাই। সেখানে যখন আমরা হায়েনা দেখছিলাম, বাবু আমার কোল থেকে নেমে যায়। তখন সে হঠাৎ করেই হায়েনার খাঁচার সামনে চলে যায়, হায়েনাটি ঠিক পাশেই বসা ছিল। আমরা কোন কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই বাবু কুকুর বা বিড়াল ভেবে খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই হায়েনাটি কামড় দিয়ে হাত ধরে ফেলে। তখন আমরা হাত ধরে টানাটানি করতে থাকি, কিন্তু কোনরকমেই হাতটি ছাড়াতে পারিনি। একেবারে হাতের কব্জিটি ছিঁড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।

তিনি বলেন, চোখের সামনে আমার ছেলের হাতটি টেনে ছিড়ে খেয়ে ফেলল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। তখন আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিল। অনেক মানুষে অনেক চেষ্টা করছে, তারপরও হাতটা ছাড়িয়ে আনতে পারিনি।

আরও পড়ুন : মিরপুর চিড়িয়াখানায় শিশুর হাত খেয়ে ফেলল হায়েনা

‘সাইফ হায়েনাটিকে বিড়াল বা কুকুর ভেবে হাত দিয়ে ধরে আদর করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার ছেলে প্রাণীটিকে ধরার আগেই উল্টো সেটি ছেলের হাত ধরে ফেলে। শুধু যে হাতে কামড় দিয়েছে তা নয়, বাবুটাকে অনেক খামচিও দিয়েছে।'

চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে শিশুটির মা বলেন, চিড়িয়াখানায় হায়েনার খাঁচার সামনে কোনোরকম ব্যারিকেড বা নিরাপত্তা ছিল না। যে কারণে ছোট বাচ্চাটি এক দৌড়ে খাঁচা সামনে চলে গিয়েছে। যে কেউ চাইলেই ওখানে চলে যেতে পারে। কোনো গেট ছিল না। যদি ওখানে একটা গেট থাকতো, তাহলে এমন ছোট্ট একটা বাচ্চা এক দৌড়ে সরাসরি খাঁচায় চলে যেতে পারত না।

এই পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে কী করবো, কোথায় যাবো?
চিকিৎসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলের হাতে অপারেশন হয়েছে। এখন ডাক্তাররা নিয়মিত এসে খোঁজ খবর নিচ্ছে, ওষুধ দিচ্ছে। ওই দিনের তুলনায় এখন আমার বাবু কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।

যখনই আমার মনে হয় আমার ছেলের হাতটা নেই, তখন নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারি না। সরকার এবং চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে এখন আমাদের দাবি, আমার ছেলের হাত তো আর ফিরে আসবে না, দয়া করে আমার ছেলেটির ভবিষ্যতের দায়িত্ব আপনারা নিন। আমি এই পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে কী করবো, কোথায় যাবো? ভবিষ্যতে সে কী করবে? তার হাত নাই, তাকে কি কেউ চাকরি-বাকরি দেবে? সে কি কাজ করে খেতে পারবে?

চিড়িয়াখানায় যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না
চিড়িয়াখানায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও শিশু সাইফের নানা শরিফুল ইসলাম বলেন, সেদিন আমিও চিড়িয়াখানায় উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু যখনই ঘটনা ঘটলো, তার একটু আগেও ছেলেটি আমার কোলেই ছিল। যখনই আমি তাকে মায়ের কাছে রেখে প্রস্রাব করতে গেলাম, পরেই শুনি এখানে চিৎকার। দৌড়ে এসে দেখি হায়েনার মুখে আমার নাতির হাত। তখন আর টানাটানি করেও লাভ হলো না। এক পর্যায়ে কব্জি থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে কোনোরকম তার হাত চেপে ধরে চিড়িয়াখানার অফিসে চলে যাই, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাদের সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পাঠায়। কিন্তু সেখানেও তারা আমার নাতিকে না রেখে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়। তারপর এখানে আসার পর চিকিৎসা শুরু হয়।

চিড়িয়াখানায় যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না অভিযোগ করে তিনি বলেন, থাকলে হয়ত আমার নাতির আজকে হাত হারাতে হতো না। এখন শুনছি তারা নিরাপত্তা জোরদার করছে। এতে আমাদের কি লাভ? আমরা তো যা হারানোর হারিয়েই ফেলেছি।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, চিকিৎসা বাবদ কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু আমার নাতিটাতো সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল, ক্ষতিপূরণ দিয়ে এখন আর কী হবে? সরকার এবং চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে একটাই আবেদন, তারা যেন আমার নাতির সারা জীবনের দায়িত্ব নেয়। কোনো একটা ব্যবস্থা যেন করে দেয়, সারা জীবন খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। এটাই আমাদের একমাত্র আবদার। তার হাত তো আমরা ফিরে পাবো না।

শারীরিক অবস্থার উন্নতি, তবে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নয়
কর্তব্যরত চিকিৎসক ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এমএইচ তোফায়েল (বিপ্লব) ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন রোগীর অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে এখনও তাকে আমরা পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত বলছি না। তার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, শরীরের বেশিরভাগ রক্ত চলে গেছে, এখন আমরা তাকে আমাদের অবজারভেশনে রেখেছি। তার হাতের যে অংশটা কাটা ছিল, সেটিকে আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তার ইমপ্রুভ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা মানুষের বড় কোনো অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পর যেকোনো অঙ্গেই প্রভাব পড়তে পারে। এটাকে আমরা সেকেন্ডারি ট্রমা বলি। পরবর্তী সময়ে যদি কোনো কারণে ছেলেটির ইনফেকশন হয়ে যায় তাহলে তার মাল্টি অর্গান ফেলিওর বা তার দেহের লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ অকৃতকার্য হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমরা তাকে এখনো শঙ্কামুক্ত বলছি না। তাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে এবং চিকিৎসা নিয়ে যেতে হবে।

শিশুটি এখন মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। সে কোন মানুষকে তার আশেপাশে দেখলে ভয় পাচ্ছে। শুধু শিশু নয় যেকোনো বয়সেরই কোনো ব্যক্তির সঙ্গে এমনটি করলে তারও এই অবস্থা হতো। ছোট বাচ্চা মানুষ, তার তো এ সমস্যা আরও বেশি হওয়ার কথা। আমার মনে হয় তাকে এখন একটু নীরবে-নিভৃতে রাখা উচিত, মানুষের চলাচল কিছুটা কম। বাচ্চাদের সঙ্গে কম কথা বললেই এখন ভালো। তারপরও আমাদের চিকিৎসা শেষ হলে তাকে একজন সাইকিয়াট্রি (মনোরোগ) বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি গঠন, সহযোগিতার আশ্বাস
এদিকে শিশু সাইফের দুর্ঘটনার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে চিড়িয়াখানার সহকারী পরিচালক মুজিবুর রহমানকে। এবিষয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, শিশুর কব্জি হারানোর ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে এবং কমিটিতে আমাকে প্রধান করে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরও একজনকে রাখা হয়েছে। তদন্ত করে এতে কারও অবহেলা আছে কী না, সেবিষয়ে শিগগিরই কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দেব।

তিনি বলেন, এ ঘটনার পর থেকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ শিশুটির চিকিৎসার জন্য ৩৫ হাজার টাকা সাহায্য করেছে। প্রয়োজনে আরও সহযোগিতা করা হবে। আমরা নিয়মিত তার খোঁজখবর রাখছি। তার অবস্থা মোটামুটি ভালো। এখন অনেকটা শঙ্কামুক্ত।

টিআই/এসএম