৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ
৫৮২ কোটি টাকার দুর্নীতি : পোটনের নথি চেয়ে ২ ব্যাংকে দুদকের চিঠি
৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করে সরকারের ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খানের (পোটন) বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এবার অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে ঢাকা ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংকের ম্যানেজারকে চিঠি দিয়েছে দুদক।
সোমবার (২৯মে) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে চাহিদাকৃত নথিপত্র আগামী ১ জুনের মধ্যে জমা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংক গ্যারান্টিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়ে মধুমতি ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপককে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
টিমের প্রধান উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানের সই করা চিঠিতে অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংক গ্যারান্টিগুলো যাচাইপূর্বক রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে ১ জুনের মধ্যে দুদকে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে একই ঘটনা অনুসন্ধানে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) কাছে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে গত ৪ এপ্রিল চিঠি দিয়েছিল দুদক। যার বেশকিছু নথিপত্র দুদকে এসেছে বলে জানা গেছে।
কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে ও সঠিক সময়ে সার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানি করে সরকার। অভিযোগ উঠেছে, এর মধ্যে ৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করেছে সাবেক এমপি পোটনের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। এ ঘটনায় সরকারের প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বিসিআইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
সার আত্মসাতের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দুদককে নির্দেশ দেন আদালত। হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। গত ২৯ মার্চ দুদকের উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ।
অভিযোগের বিষয়ে সাবেক এমপি ও পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খানের (পোটন) কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
দুদক পরিচালক আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদের সই করা চিঠিতে অনুসন্ধানের নির্দেশনার বিষয়টি জানানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে গত ৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ স্বপ্রণোদিত রুল ইস্যু করেন। একই সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে আগামী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান সম্পন্ন করে আদালতে দাখিলের জন্য দুদককে নির্দেশ প্রদান করেন।
অভিযোগ ও বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সারগুলো ৫০ দিনের মধ্যে গুদামে পৌঁছে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী পৌঁছানোও হয়। কিন্তু হিসাব বলছে খালাস হওয়া সারের মধ্যে ৭২ হাজার টন গুদামে সরবরাহ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। যার বাজারমূল্য ৫৮২ কোটি টাকা।
পোটন ট্রেডার্সের গুদামে আমদানি করা সার মজুত আছে কি-না যাচাই করতে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর বিসিআইসি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই ২ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোটন ট্রেডার্স গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে জানিয়েছিল তাদের ৬টি গুদামে ৬৬ হাজার টন সার রয়েছে। তবে সরেজমিন তদন্তে গিয়ে গুদামে মাত্র ১ হাজার ৩০০ টন সার পাওয়া যায়। ওই সারও ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ মে’র মধ্যে ওই সার খালাস হয়েছিল।
সার আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি। তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
সার সরবরাহ না করার পর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি বিসিআইসি। সর্বশেষ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিসিআইসির পক্ষ থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়।
সার মজুত না থাকার বিষয়টি পোটন ট্রেডার্সের মহাব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন ও মহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) নাজমুল হোসেন তদন্ত টিমের কাছে স্বীকার করেন এবং তারা এ বিষয়ক নথিতে সইও করেছেন বলে জানা গেছে।
সার আত্মসাতের ঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না পোটনের মালিকানাধীন মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। সরকারিভাবে আমদানি করা সারগুলো বন্দর থেকে খালাসের পর গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল পোটন ট্রেডার্সের। পোটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
কামরুল আশরাফ খান পোটন ২০১৪ সালে নরসিংদী-২ আসনে জাসদের প্রার্থী জায়েদুল কবিরকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হন। জায়েদুল মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। কামরুল আশরাফ খান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য তার ভাই আনোয়ারুল আশরাফ খান, যিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত।
আরএম/কেএ